ইগোর বিবর্তন — বড় ইগো, ছোট ইগো, অতঃপর মুক্তি

মানুষের ইগো আছে। প্রায় সব মানুষেরই। বলা যায় যে ইগো থাকার কারনেই একটা প্রাণীরে মানুষ নামে ডাকা হয়। যার ইগো নাই, সে মানুষ না। ইগো শব্দটার একটা বাংলা অর্থ হইলো অহং। তবে এই বাংলা শব্দটার অর্থের সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে আমি এইখানে ‘ইগো’ শব্দটাই ব্যবহার করব। ইগো জিনিসটা অহংকারের পর্যায়ে পৌঁছাইয়া গেলে তখন মানুষ এইটারে নেগেটিভলি নিলেও বেশীরভাগ সময় পজেটিভলিই নেয়। কারণ ইগো বলতে সাধারণত মানুষ নিজের আত্মমর্যাদা বোধ এবং ব্যক্তিত্বরে বোঝে। আর সবাই নিজের ব্যক্তিত্বরে শক্ত কইরা আঁকড়াইয়া ধইরা ডিফেন্স করতে চায়, এবং এইটা ইগোরই একটা কাজ। তাই ইগোরে প্রায় সবাই ভালোবাসে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ইগো বলতে আসলে শুধু আত্মমর্যাদা বোধ এবং ব্যক্তিত্ব বোঝানো হয় না। ইগো হইলো একটা মানুষের আলাদা সত্তার কনসেপ্ট যেইটা একটা মানুষরে একটা লিমিটেড সেন্সের মধ্যে আবদ্ধ কইরা ফালায়। অন্য কথায় বলতে গেলে, মানুষের যখন নিজের অস্তিত্ব নিয়া ক্লিয়ার ধারনা থাকে না তখন সে নিজেরে নিয়া একটা “Poor little me” কনসেপ্ট তৈরি করে, যেইখানে সে সবকিছুর মাঝখানে নিজেরে খুব একা এবং আলাদা মনে করে, এবং সে এই আলাদা নিজটারে সবসময় একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টে নিয়া যাইতে চায় আত্মমর্যাদা বোধ এবং ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়া। আর এই আত্মমর্যাদা বোধ এবং ব্যক্তিত্বরে ধইরা রাখতে গিয়া প্রতিনিয়ত তাঁরে একটা ডিফেন্সিভ মুডে থাকতে হয়। কিন্তু মজার বিষয় হইলো, ইগো নিয়া মানুষের এই পুরা জিনিসটাই হইলো মিথ্যা, নিজের বানানো। অর্থাৎ, ইগো কোন অবজেকটিভ রিয়্যালিটি না। এইটা মিথ্যা হওয়ার কারনেই প্রতিটা মানুষ তাঁর নিজ নিজ ইগোরে নিজের অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থানের উপর ভিত্তি কইরা একটা নির্দিষ্ট শেইপ দিয়া বানাইয়া নেয়। এইরকম একটা মিথ্যা জিনিস মানবজাতির মনের মধ্যে ঠিক কখন ঢুইকা পড়ছে সেইটার সঠিক ইতিহাস আমার জানা নাই। কারণ ইগো নিয়া ইতিহাস রচিয়তারা তেমন একটা ভাবে নাই, তাঁদের ইগোই তাঁদেরকে ইগো নিয়া ভাবতে দেয় নাই। তবে ইতিহাস খুইলা বসলে সেইখান থাইকা ইগোর একটা ঝাপসা টাইমলাইন খুইজা পাওয়া যায়, যেইটা নিজে খুইজা নিতে হয়, সেইটাই আমি এইখানে আপনাদের শোনাইতে যাইতেছি।



ইগো যে শুধু একটা ব্যক্তির ব্যক্তিগত জিনিস তা না। ইগো হয় পারিবারিক, ইগো হয় বংশগত, ইগো হয় ধর্মীয়, ইগো হয় জাতীয় এবং ইগো হয় আন্তর্জাতিক। ইতিহাসের দিকে তাকাইলে দেখা যায় ইগো শুরু হইছে জাতীয় আর ধর্মীয় লেবেল থাইকা। যেইটারে আমি বলি বড় ইগো। এই বড় ইগোই মানুষরে রুল কইরা গেছে শত শত বছর। এখনো যাইতাছে, তবে আগের মত না। পৃথিবীতে যতগুলা ধর্ম ছিল তাঁর সবগুলা অনুসারীরই মাথার মধ্যে ঢুকানো হইছে ধর্মীয় ইগো, যেই ইগো বলতে থাকে যে তাঁর ধর্ম ছাড়া বাকি সব ধর্মই ভুয়া এবং তাঁরে তাঁর নিজ ধর্ম রক্ষা করতে হবে। তারপর আসে জাতীয় ইগো। জাতীয় ইগো মানুষের মনে নিজ জাতীরে, নিজের দেশরে পবিত্রতম কইরা তুলে। এইসব ইগো থাইকা জন্ম হইছে যুদ্ধ নামের জঘন্যতম জিনিসের। পৃথিবীতে যত যুদ্ধ সংঘটিত হইছে, যত রক্তপাত হইছে, যত মানুষ যত মানুষরে খুন করছে, যত মানুষ অন্য মানুষের উপর অত্যাচার চালাইছে, প্রকৃতির উপর মানুষ যত ধ্বংসযজ্ঞ চালাইছে, মানুষের দ্বারা যত ক্যালামিটি সংঘটিত হইতেছে, তাঁর সবকিছুর পেছনে একটা জিনিসই দায়ী — ইগো।

এই ইগো সময়ে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হইছে। ইতিহাসের যেই সময়টাতে যুদ্ধরে সবাই একমনে গৌরবের বিষয় বইলা মাইনা নিত, তখন ইগো কাজ করত একভাবে। তখন মানুষ তাঁর ব্যক্তিগত ইগোরে অতটা পাত্তা দিত না। এবং মানুষের নিজের ব্যক্তিগত একটা ইগো থাকতে পারে যেইটার মূল্য জীবনে সবচাইতে বেশী, সেই সেন্সটা তখন মানুষের মনে গ্রো করে নাই। কারণ তখন সারাক্ষণ পৃথিবীর কোন না কোন জায়গায় যুদ্ধ লাইগাই থাকত। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেইখা মানুষ আঁতকাইয়া উঠলেও যুদ্ধরেই মানুষ রিয়্যালিটি মনে করত। যুদ্ধে সব সময় সাধারণ মানুষ মরলেও, এই মরণরে মানুষ গৌরবের মরণ মনে করত। এবং যারা যুদ্ধে লিড দিত তাঁরা কখনই মারা যাইত না, গেলেও সেইটা খুবই রেয়ার। কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভ করলে পুরা ক্রেডিটটা নিয়া নিত রাজারাই, সাধারণ মানুষও মনে করত এই ক্রেডিট রাজারই প্রাপ্য। কারণ তখন সবাই ছিল বড় ইগোতে আক্রান্ত। এবং আরও মজার বিষয় হইলো, তখনকার সময় যেইসব আর্টিস্ট, পেইন্টার ছিল, তাঁরাও সবাই বড় ইগোরই জয়গান গাইত।

Portrait of Gustav II Adolf of Sweden leading his army to victory at the Battle of Breitenfeld. Painted by Johann Walter. Dated 17th Century. (Photo by: Universal History Archive/UIG via Getty Images)
Portrait of Gustav II Adolf of Sweden leading his army to victory at the Battle of Breitenfeld. Painted by Johann Walter. Dated 17th Century.

উদাহরণ স্বরূপ উপরের পেইন্টিংটার উপর চোখ বুলান। এইটা হইলো “Battle of Breitenfeld”। এই যুদ্ধ সংঘটিত হইছিল ১৬৩১ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর। এই পেইন্টিং এ পেইন্টার জিন ওয়াল্টার সুইডেনের রাজা গুস্তাভ এডলফরে গ্লরিফাই করছে। দেখেন ছবির দিকে তাকাইলে শুধু রাজারেই চোখে পড়ে। আর যারা যুদ্ধে মারা গেছে, যারা যুদ্ধটার মেইন বডি ছিল, অর্থাৎ সব সাধারণ সৈন্যরা — তাঁদের চেহারা কিন্তু এই ছবিতে ফুইটা উঠে নাই। যুদ্ধকালিন সময়ে তাঁদের কি অনুভূতি হইছিল, সেইটার কোন গুরুত্বই নাই। এইরকম আরও অনেক ছবি, নাটক, বই লেখা হইছে, যেইখানে কেবল গাওয়া হইছে বড় ইগোর জয়গান। পুরুষত্ব, বীরত্ব, আর জাতীয়তাবাদী বোধ দিয়া মানুষরে গিলানো হইছে এই বড় ইগো। আর মানুষ এই ইগোর পুজা কইরা গেছে শত শত বছর। সবাই নিজের পেটে ধরা ছেলেকে যুদ্ধে পাঠাইয়া শহীদ কইরা অনুভব করছে বড় ইগোর গর্ব। তখন মানুষ রাজাদেরকে গডের সন্তান মনে করতো। ভাবতো যত যুদ্ধ হইতেছে সবই ডিভাইন অর্ডারের উপর ভিত্তি কইরা হইতেছে, কারণ তাঁদেরকে এইটাই বুঝানো হইত।

কিন্তু সময় তো আর বইসা থাকে না। চলতে থাকে, আর সাথে নিয়া আসতে থাকে পরিবর্তন। ধীরে বড় ইগোর ধারনাও পরিবর্তিত হইতে লাগলো। মানুষ বড় ইগো থাইকা নাইমা আসতে লাগল ছোট ইগোতে। মানুষ ব্যক্তির অনুভূতির উপর ফোকাস করা শুরু করলো। আর্টিস্টরাও তাঁদের পেইন্টিঙের ফোকাস চেইঞ্জ কইরা ফেলল।

tom_lea_-_2000_yard_stare
Tom Lea, That 2,000 Yard Stare (1944)

উপরে যে ছবিটা দেখতেছেন, এইটা হইলো ডিক্স এন্ড লি এর পেইন্টিং। ছবিটা আপনারে যা বলতেছে তা হইলো, যুদ্ধ কি জিনিস সেইটা বুঝতে পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়ানো যুদ্ধের জেনারেলের দিকে আপনারে তাকাইতে হইব না, বরং যুদ্ধের একজন সাধারণ সৈন্যের চোখের দিকে সরাসরি তাকাইলেই বুঝতে পারবেন যুদ্ধ কতটা গৌরবের বিষয়! এইখানে মানুষ বড় ইগো থাইকা ছোট ইগোতে নাইমা আসছে। মানুষ ইনডিভিজুয়ালের অনুভূতির উপর ফোকাস করা শুরু করছে। তৈরি হইছে Apocalypse Now, The Thin Red Line, Full Metal Jacket এর মত অনেক ব্লকবাসটার অ্যান্টি ওয়ার ফিল্ম। দেখানো হইছে যুদ্ধ কত ভয়ঙ্কর, যুদ্ধ কতটা অর্থহীন।

বর্তমানে মানুষ মিনিমালিজমের দিকে আগাইতেছে। মানুষের বিনোদনও হইয়া উঠতেছে মিনিমালিষ্ট। মানুষ এখন ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, ব্যক্তির অনুভূতিরে গুরুত্ব দেয়। এখন হত দরিদ্র মানুষের জীবনের করুণ কাহিনী নিয়া উপন্যাস লিখলে সেইটা নোবেল পুরুস্কার পায়। তবে প্রশ্ন হইলো, তাইলে কি এখন মানুষ বড় ইগো থাইকা একেবারেই বাইর হইয়া আসছে? উত্তর হইলো, না। বড় ইগোর প্রভাব আগের মত না থাকলেও মানুষ এখনো বড় ইগোরে মাইনা চলে। সেই জন্যেই মানুষ দেশের প্রেসিডেন্টরে ভোট দিয়া ক্ষমতায় বসায় তাঁরে শাসন করার লাইগা। এখনো মানুষ সুপার হিরো মুভি দেখে, নিজেরে সুপার হিরোর জায়গায় কল্পনা কইরা ইগোর স্বাদ মিটায়। বড় ইগোর আরেকটা নতুন ফর্ম হইলো, খেলা। বিশেষ কইরা ক্রিকেট খেলা। মানুষ তাঁর জাতীয় ইগোরে ফিড করায় ক্রিকেট খেলার হার-জিত দিয়া। খেলাধুলা খুবই ভালো জিনিস। একটা মানুষ জন্মের পর থাইকাই খেলাধুলা করে। খেলাধুলা ছাড়া কোন মানুষই বড় হইতে পারে না। বাচ্চারা যখন খেলে সেইখানে হার জিতের ব্যপার থাকলেও কোন ইগো থাকে না। হারুক আর জিতুক, তাঁর কাছে খেলাটাই মুখ্য। যে কোন খেলায় যখন মানুষ খেলতে নামে তখন সে জিততে চাইলেও জিতাটা তাঁর কাছে মুখ্য হয় না, কারণ খেলার আনন্দ খেলাতেই। কিন্তু মানুষ হঠাৎ কইরা নিজে খেলা বাদ দিয়া দিল। নিজে না খেইলা খেলা দেখা শুরু করলো। কিছু খেলোয়াড়রে টাকা দিয়া খেলতে নামাইয়া দিয়া সবাই সেই খেলা দেখে বইসা বইসা। দেখে কে হারে আর কে জিতে। অথচ যেই খেলাটা মানুষ দেখতেছে এই খেলায় একটা খেলোয়াড়ও মনের আনন্দে খেলতে নামে নাই, নামছে টাকার জন্যে। আর সেইটা দেইখা সাধারণ মানুষ তাঁর জাতীয় ইগোরে ফুলায়। যেইখানে আগে মানুষ সুস্বাস্থ্য নিয়া খেলতে নামত, সেইখানে এখন মানুষ নিজের বড় ভুরিটা নিয়া টিভির সামনে বইসা বইসা খেলা দেখে, যেই খেলা কোন ন্যাচারাল খেলা না।

সর্বোপরি ব্যপারটা হইলো, এখন এমন একটা সময় চলতেছে যেইখানে মানুষ বড় ইগো থাইকা ধীরে ধীরে ছোট ইগোর দিকে আগাইতেছে। কিন্তু বড় ইগোরে ছাড়ে নাই পুরাপুরি। বর্তমানে বিশ্বে সবচাইতে জনপ্রিয় টিভি সিরিজ হইলো, গেম অব থ্রন্স। এই সিরিজের ইউনিকনেস হইলো, এইটাতে বড় ইগো আর ছোট ইগোর একটা পারফেক্ট সংমিশ্রণ দেখানো হইছে। এই সিরিজের মূল কাহিনী আবর্তিত হইতেছে ক্ষমতার লড়াই নিয়া, দেখানো হইতেছে রাজা-বাদশাদের আভিজাত্য, পাওয়ার, নিষ্ঠুরতা, ক্ষোভ আর লোভ। এইগুলা দেইখা মানুষ মজা পাইতেছে ব্যপক। এতে তাঁদের বড় ইগোর খাবারের যোগান হইতেছে। পাশাপাশি এই সিরিজের প্রতিটা এপিসোডেই ইনডিভিজুয়াল ক্যারেক্টারের অনুভূতির উপর ফোকাস ফেলা হইয়া থাকে। সূক্ষ্ম থাইকা সূক্ষ্মতম অনুভুতিগুলাও খুব সুন্দর কইরা ফুটাইয়া তোলা হয় এইখানে। সেইটাও মানুষ উপভোগ করতেছে ইনটেন্সলি।



এখন মূল প্রশ্ন হইলো, বড় হোক আর ছোট হোক ইগো তো একটা মিথ্যা জিনিস, এইটারে কি তাইলে ঝাইড়া ফেলে দেয়া উচিত? উত্তর হইলো, হ্যাঁ। ইতিহাসে গুটি কয়েক ফিগার দেখা যায়, যারা ইগোরে বাদ দিয়া দিছে। এবং মানুষরেও বাদ দেওয়ার আহবান কইরা গেছে। এখনো অনেক ইনডিভিজুয়াল ইগো বাদ দেওয়ার সাধনা করতেছে বিশ্বব্যাপী। তবে তাঁদের সংখ্যা খুবই কম। হাতের আঙুল দিয়াই গোনা যায়। তবে কালেকটিভ চিত্রটার দিকে তাকাইলে দেখা যায়, প্রাণীকুলের বিবর্তনের মত মানুষের ইগোও বিবর্তিত হইতেছে। মানুষ ইগোর ভারে ধীরে হইয়া উঠতেছে ক্লান্ত। ধীরে হইতে যাইতেছে ইগোলেস। হয়তো আরও মিলিয়ন বছর লাগব পুরোপুরি ইগোলেস হইতে, মুক্তি পাইতে। লাগুক। মানুষ সেদিকেই হাঁটব, আর কোন রাস্তা নাই।

এখন প্রশ্ন হইলো, ইগো না থাকলে মানুষ কি করব? ইগোর জায়গা পূরণ হইব কি দিয়া? উত্তর হইলো, ভালোবাসা দিয়া, প্রেম দিয়া। মানুষ এখনো ইগোলেস হয়, যখন সে প্রেমে পড়ে, যখন সে ভালোবাসে। মানুষ যখন প্রেমে পড়ে অন্য মানুষের, যখন প্রেমে পড়ে প্রকৃতির, যখন প্রেমে পড়ে অস্তিত্বের, তখন সে হইয়া যায় আত্মহারা, তখন সে হইয়া যায় লিমিটলেস। তখন সে আর মানুষ থাকে না। ‘মানুষ’ তো কেবল একটা নাম যা মানুষ মানুষরে দিছে। এই ‘মানুষ’ নামরে টপকাইয়া তখন সে হইয়া যায় জীবন, কেবলই জীবন, সীমাহীন জীবন।

নভেম্বর ২৮, ২০১৬।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *