ভাষার সীমাবদ্ধতা, রিয়্যালিটির বিশালতা আর আমাদের ডিসকানেকশন

পৃথিবীর প্রতিটা কোণায় প্রতিটা মানুষ একই ভাষায় হাসে, কাঁদে, খায়, ঘুমায়, ভালোবাসে এবং যৌন কর্ম সাধন করে। মানুষের সুখ, দুঃখ আর কষ্টের অনুভূতিগুলাও উঠা নামা করে একই ভাষায়। মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড, আবেগ এবং অনুভূতিতে আপনে ব্যাসিক কোন পার্থক্য খুইজা পাইবেন না। ব্যাসিক পার্থক্যটা আপনে খুইজা পাইবেন মানুষের অরিজিন, দেশ, জাতি, ধর্ম এবং বর্ণে। এইগুলা যদিও আসলে কোন পার্থক্য না, বরং বৈচিত্রতা, তবুও আমরা এইসব দিয়াই মানুষে মানুষে পার্থক্য তৈরি করি। এইসব দিয়াই আমরা মানুষরে বিচার করি। এই কাজটা প্রায় বিশ্বের সব দেশের মানুষই করে। “Us vs Them” এর মত বিষাক্ত কনসেপ্ট আর দেশের জাতীয়তাবাদী বর্ডার দিয়া সব দেশের মানুষই ভাগাভাগির চর্চাটা কইরা থাকে। আমাদের দেশে এই রেসিজম চলে জেলা ভিত্তিক। কেউ নোয়াখালী অথবা বরিশালে জন্মাইলেই সে নির্দিষ্ট একটা ক্যাটাগরিতে পইড়া যায় অটোমেটিকেলি। বিষয়টা যতই হাস্যকর হোক, এইটা উচ্চ শিক্ষিত লোকেরা প্রতিনিয়ত চর্চা কইরা যায়। এখন প্রশ্ন হইলো, মানুষ এইটা কেন করে? মানুষের এইটা করার কারণ হইলো, মানুষের মধ্যকার ডিসকানেকশন আর মিসকমুনিকেশন। আর এইখানে যেই জিনিসটা বড় ধরণের রোল প্লে করে সেইটা হইলো ল্যাঙ্গুয়েজ। সুতরাং বুঝতেই পারতেছেন আমি এখন ভাষা নিয়া কথা বলব। চলেন আমাদের রিয়্যালিটিতে ভাষার দৌড় কতটুকু সেইটা নিয়া একটু আলোচনা করি।



যদিও মানুষের ব্যাসিক কর্মকাণ্ডগুলার ভাষা একই, কিন্তু বিভিন্ন দেশের মানুষের কথা বলার ভাষা আবার ভিন্ন ভিন্ন। এবং বেশীরভাগ সময় আমরা ভাষা দিয়াই একে অন্যের সাথে কমুনিকেট করার চেষ্টা করি, কিন্তু ভাষা দিয়া সম্পূর্ণ কমুনিকেশন করা কখনই হইয়া উঠে না। যেমন লেখকের ভাষা পাঠক পুরাপুরি বুইঝা উঠে না, স্বামীর ভাষা স্ত্রী বুঝে না অথবা স্ত্রী কি বুঝাইতে চায় তা স্বামী বুঝে না, প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যেও থাকে মিসকমুনিকেশন, এবং ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল লেভেলেও আছে কমুনিকেশন গ্যাপ। এখন এই সমস্যা মানুষের ভাষা ভিন্ন অথবা ডায়ালেক্ট ভিন্ন হওয়ার কারণে হয় না। মূল সমস্যাটা হইলো, পৃথিবীর কোন ভাষা অথবা কোন ডায়ালেক্ট দিয়াই আপনে রিয়েলিটিরে এক্স্যাক্টলি বর্ণনা করতে পারবেন না। এইটা ভাষার সীমাবদ্ধতা। রিয়্যালিটিতে এত বেশী প্যারাডক্স আছে যে, সেইটা বর্ণনা করতে একই শব্দ এবং একই বাক্য ভিন্ন ভিন্ন অর্থে বার বার ব্যবহার করতে হয়। ভাষার এই ব্যবহারে মানুষের মুখের কথা অথবা লেখকের লেখা অনেক টুইস্টি হইয়া উঠলেও, তা বেশীরভাগ সময় মিস কমুনিকেশনের কারণ হইয়া দাঁড়ায়।

আমরা যেই রিয়্যালিটিতে বসবাস করি তাঁর খুব অল্পই ভাষা দিয়া বর্ণনা করা যায় এবং একে অন্যের সাথে যে ভাবের আদান প্রদান করতে চাই তাও খুবই অল্প ভাষা দিয়া করা যায়। সেই জন্যেই আমরা খুব সুন্দর অথবা খুব খারাপ কোন কিছু দেইখা, শুইনা অথবা পইড়া আমাদের ভেতরের গভীর আবেগটা প্রকাশ করতে গিয়া ভাষা হারাইয়া ফেলি। কারণ সেই আবেগ প্রকাশ করার ভাষা আসলেই নাই।  ভাষা হইলো কিছু শব্দের সমষ্টি। আর এই শব্দগুলা হইলো রিয়্যালিটি বর্ণনা করার জন্যে ব্যবহৃত সিম্বল। এই সিম্বলগুলা দিয়া রিয়্যালিটির একটা আবছা অবয়ব বর্ণনা করা গেলেও, পরিষ্কার চিত্রটা কখনই তুইলা ধরা সম্ভব হয় না। তাইলে কি ভাষা দিয়া কিছুতেই সত্যিকার ভাবের আদান প্রদান সম্ভব না? যুগ যুগ ধইরা মানুষ তাইলে কি কইরা আসতেছে? উত্তর হইলো, ভাষা শুধু রিয়্যালিটির সাইন পোস্ট হিসেবে ব্যবহৃত হইতে পারে, এবং সেইটাই হইয়া আসতেছে। এই সাইন পোস্ট দিয়া পূর্ণ কমুনিকেশন তখনই সম্ভব, যখন মানুষ একে অন্যের সাথে হারমনিয়াসলি কানেক্টেড থাকে, যেইখানে তাঁরা শব্দের ব্যবহার ছাড়া অথবা শব্দের বাইরে গিয়া একে অপরের মনের ভাষা বুঝতে পারে।

মানুষের উইজডম আর ভালোবাসা মূলত এইভাবেই শেয়ার করা হইয়া থাকে।

কিন্তু সমস্যা হইলো, বেশীরভাগ মানুষ অজ্ঞতা আর ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত হইয়া পড়াতে, মানুষের এই কানেকশনের কথা তাঁরা ভুইলা গেছে। তাঁরা এখন এপারেন্ট ভাষাটারেই রিয়্যালিটি মনে করে। সারা পৃথিবীতে মানুষ সারাক্ষণ শুধু বকবক করে। সবাই কথা বইলাই যায়। আর এনটায়ার হিউম্যান রেইসের এই টকেটিভন্যাসরে বলা যায় “ল্যাক অব রিয়েল কমুনিক্যাশন”। সবাই একে অন্যের সাথে ভাবের আদান প্রদান করার সময় মুখের কথা দিয়া একটা ইমাজিনারি কমুনিকেটিভ ব্রিজ তৈরি করার চেষ্টা করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হইলো, এই ব্রিজ খুব সহজেই ভাইঙ্গা পড়ে। এই ব্রিজের উপর ভিত্তি কইরাই গইড়া উঠে প্রতিটা সম্পর্ক। ফল স্বরূপ, বেশীরভাগ সম্পর্কই শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হয় ব্যর্থতায়। এইরকম যখন চলতে থাকে, মানুষ যখন কথারে অথবা ভাষারেই রিয়্যালিটি মনে করে, তখন সে মনের দিক থাইকা অস্থির হইয়া উঠে। মানুষের মনটা হইল বানরের মত। এইটা সারাক্ষণ শুধু লাফায়। মনের এই অস্থির লাফালাফিরে জেন বুদ্ধিজমে বলা হয় “মাঙ্কি চ্যাটার”। এখন তাইলে এই সমস্যার সমাধান কি? সমাধান হইলো, মনটারে শান্ত করা, নীরবতারে ওয়েলকাম জানানো, মাঝে মাঝে নীরবতায় ডুইবা যাওয়া। গৌতম বুদ্ধ একবার বলছিলেন,

“আপনে যদি যথেষ্ট শান্ত হইতে পারেন, তাইলে আপনে এই মহাবিশ্বের প্রবাহটা স্পষ্ট কইরা শুনতে পাইবেন। মহাবিশ্বের ছন্দটারে অনুভব করতে পারবেন।”

আপনার আশেপাশে যা কিছু আছে এবং যারাই আছে, এই সবকিছুর সাথে তখনই আপনার সত্যিকারের সম্পর্ক তৈরি হইব, যখন আপনে সবকিছুর সাথে সবকিছুর কানেকশনটা দেখতে পাইবেন। যেই কানেকশন কোন কথা দিয়া, অথবা ভাষা দিয়া তৈরি হয় নাই। আপনে যদি কাউরে ভালোবাসেন, তাইলে সেইটা দেখান, মুখে বইলেন না। আপনে যদি এই দুনিয়ার জন্যে ভালো কিছু করতে চান, তাইলে কাজে নাইমা পড়েন। এইটারে নিয়া বাজনা বাজাইয়েন না। এক্সপ্রেসিব হন, খুবই এক্সপ্রেসিব। তবে সেইটা হন আপনার কাজের মধ্য দিয়া, কথার মধ্য দিয়া না। আপনার কাজরে কথা কইতে দেন, আপনার অস্তিত্বরে কথা কইতে দেন। মুখটারে মাঝে মধ্যে একটু থামাইয়া রাখেন। শব্দ খুবই লিমিটেড। কিন্তু আপনার অস্তিত্ব হইলো আনলিমিটেড, এইটারে শব্দ দিয়া কোন লিমিটেশনের মধ্যে ফালানোর চেষ্টা করাটা হাস্যকর। বড়ই হাস্যকর।



এখন শেষ প্রশ্ন হইলো, এই যে এত কিছু বললাম। এর সবকিছুর মূল কালপ্রিট কি শুধু ভাষাই? উত্তর হইলো, না। তবে ভাষা এইখানে বড় ধরণের ভূমিকা রাখে। সমস্যাটা প্রকট হইয়া দাঁড়ায় তখন, যখন আমরা ভুইলা যাই যে ভাষা লিমিটেড। বিখ্যাত স্ক্রিন রাইটার কিম ক্রিজান ভাষার এই লিমিটেশন নিয়া কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন —

শুধু সারভাইবালের ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহারটা খুবই সহজ এবং কার্যকরী। যেমন ধরেন, পানি। এই শব্দটা শুনলে আমরা সবাই পানির সাথে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা মিলাইয়া তারপরে বুঝতে পারি ‘পানি’ বলতে কি বুঝায়। কিন্তু বিষয়টা একটু প্যাচ খাইয়া যায় যখন আমরা ভাষার এই সিম্বলগুলা দিয়া কোন Abtract জিনিস বুঝাইতে চাই, যেমন ‘ভালোবাসা’, ‘রাগ’, ‘ক্ষোভ’ ইত্যাদি। যখন কেউ বলে ‘ভালোবাসা’, তখন যে শুনে সে ভালোবাসার সাথে নিজের যে অভিজ্ঞতা সেইটা দিয়া বুইঝা নেয় ভালোবাসা বলতে এইখানে কি বুঝানো হইছে। কিন্তু সে কি এক্স্যাক্টলি ভালোবাসা দিয়া এইখানে কি বুঝানো হইছে তা বুঝল? বুঝলে সেইটা ক্যামনে নিশ্চিত হওয়া যাইব? শব্দ দিয়া তা নিশ্চিত হওয়া যাইব না কখনই। কারণ শব্দেরা নিষ্ক্রিয়। এইগুলা শুধুই সিম্বল। শব্দরা মৃত। আমাদের বেশীরভাগ অভিজ্ঞতাই দুর্বোধ্য। অকথ্য। কিন্তু তারপরেও আমরা যখন কথা বলি তখন মনে হয় আমরা কানেকটেড। মনে হয় আমরা একে অন্যের কথা বুঝতে পারছি। যদি এইরকম অনুভূতি হয়, এবং সেইটা যদি সত্যি হয়। তাইলে এইটারে বলা যায় “ফিলিং অব স্পিরিচুয়াল কমুনিয়ন”। এবং এইটার জন্যেই আমরা বাইচা থাকি।

শেষ কথা হইলো, ভাষা শুধুই সিম্বল। এইটা আমাদের সারভাইবালের জন্যে প্রয়োজন। ভাষার এই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকতে হইব। ভুইলা গেলেই সমস্যা, ভুল বোঝাবুঝি। ভাষার দরকার আছে। আছে বইলাই ভাষার জন্ম হইছে। এবং সেই জন্যেই আমি এই লেখাটাও ভাষা দিয়াই লেখতাছি। এবং ভবিষ্যতেও লেখব। কিন্তু ভাষা কেবলই ভাষা। এইটা তখনই উইজডমে পরিণত হইব, যখন আপনে এইটার সাথে আপনার ইনটেলেক্টরে এঙ্গেজ করবেন। তাছাড়া ভাষা কেবল কতগুলা মৃত শব্দের সমষ্টি বৈ আর কিছুই না।

অক্টোবর ০৭, ২০১৬।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *