অদৃষ্টের ভালোবাসা

মানুষের জীবনের মূল চালিকাশক্তিগুলার মধ্যে অন্যতম হইল ‘আশা’। কারও কারও ক্ষেত্রে জীবনের একমাত্র চালিকাশক্তি শুধু আশাই। আশা ছাড়া জীবন সামনের দিকে পা বাড়াইতে পারে না। আশা ছাড়া জীবনের সকল কর্মকাণ্ডই অর্থহীন। সেইটা মনে কইরাই হয়তো গিরিশ চন্দ্র ঘোষ বাংলায় ফেমাসলি একটা লাইন লেইখা গেছেন যা পরবর্তীতে ভাব-সম্প্রসারণে রূপ নিয়া পাঠ্য পুস্তকের মধ্য দিয়া আমাদের মস্তিষ্কে ছোট বেলা থাইকা বাইচা থাকার আপাত জ্বালানীর যোগান দিয়া গেছে । লাইনটা হইলো –
“সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা, আশা তার একমাত্র ভেলা।“

কথাটা অনেকটাই সত্য। অন্তত প্রথম অংশটা তো বটেই! জীবন সংসার দুঃখে ভরা। দুঃখের চাইতে বড় সত্য সংসারে আর কিছু নাই। সুখ মাঝে মধ্যে আসতে পারে। তবে দুঃখ চিরস্থায়ী। দুঃখরে এড়াইতে হাজারো ডাইভারশন দিয়া আপনি জীবন ভইরা ফেলতে পারেন, কিন্তু দুঃখ আপনার পিছু ছাড়বে না কখনই। দুঃখের এই নাছোড়বান্দা আচরণে বিচলিত হইয়া উঠছিলেন গৌতম বুদ্ধ। ঘর ছাইড়া তিনি ডুব দিছিলেন দুঃখের গভীরে।

দুঃখরে কি এড়ানো যায় না? দুঃখের কি নাশ নাই?

মানুষের আশা বলে – আছে। একদিন সবকিছু ঠিক হইয়া যাবে। একেবারে ঠিক হইয়া না গেলেও ভালো কিছু একটা হবে। আজকের চাইতে কালকের দিনটা বেটার হবে। এই মুহূর্তের চাইতে পরের মুহূর্তটা বেটার হবে, এই মাসের চাইতে পরের মাসটা বেটার হবে, এই বছরের চাইতে পরের বছরটা বেটার হবে। আর যদি আমার জীবনে কোন কিছুই বেটার না হয়, তাইলে আমার সন্তানের জীবন অবশ্যই বেটার হবে। আশা!

এইটা আশার সীমাহীন ঘোরপ্যাঁচ।

আশা যে জীবনের একমাত্র ভেলা এইটা অনেকটা সত্য হইলেও আল্টিমেট সত্য না। কারণ জীবন তার নিজস্ব ন্যাচারে আশার উপর ভর কইরা চলে না। আশায় যে বুক বান্ধে সেইটা হইলো মানুষের সাইকোলজি। অর্থাৎ আশাটা হইলো মানুষের একটা সাবজেক্টিভ ব্যাপার।

কিন্তু আশা ছাড়া বাঁচব কিভাবে? আশাই তো আমাদের বাঁচাইয়া রাখে!

হ্যাঁ, সেইটা সত্যি। তবে আশায় যে জীবন চলে সেই জীবন বন্ধী, পঙ্গু, পরাধীন এবং ক্ষুদ্র।

এইটা কেমন কথা!

হোপ ড্রিভেন লাইফে আপনি যে কাজটাই করবেন সেইটা হবে পরের মুহূর্ত, পরের দিন, পরের মাস, পরের বছরের কথা চিন্তা কইরা। কোন মুহূর্তই আপনি ঠিক উপভোগ করতে পারবেন না। কারণ প্রতিটা মুহূর্তের প্রতিটা কর্মকাণ্ডই রূপ নেবে আপনার ভবিষ্যতের আশান্বিত রেজাল্টের ট্রানজেকশন হিসেবে। আশার এই চিন্তা মানুষের কর্মকাণ্ডরে একটা প্যাটার্নে বন্ধী কইরা ফেলে।

অ্যামেরিকান লেখক চাক পালাহনিউকের নভেল থাইকা বানানো ডেভিড ফিঞ্চারের বিখ্যাত মুভি ‘ফাইট ক্লাব’ (১৯৯৯) এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ডায়লগ হইলো, “Losing all hope is freedom.”

কথাটা কাউনটার ইনটুয়িটিভ। এই কথা আপনে সহজে মাইনা নিতে পারবেন না। অর্থাৎ আপনার সাইকোলজির কাছে এইটা সেন্স মেইক করবে না। আর যদি করেও তাইলে সে সাথে সাথে হতাশ হইয়া পড়বে। কিন্তু মজার বিষয় হইলো, এই আশাহীন হওয়া মানে হতাশ হইয়া পড়া না (তবে বিষয়টা আপনার মনে পুরোপুরি সিঙ্ক ইন না করা পর্যন্ত আপনি হতাশই থাকবেন)।

সত্যিকারের স্বাধীন হইতে হইলে আপনারে আশা ছাড়তে হবে। ছাড়া বলতে আপনার আশাগুলা যে একটা ভ্রম সেইটা অনুধাবন করতে হবে।

আশার এই ছাড়াছাড়ি নিয়া আরও সুন্দর কথা বইলা গেছেন ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী দার্শনিক ফ্রেদ্রিক নিৎশে। নিৎশে বলছেন মানুষের আভ্যন্তরীণ মুক্তির জন্যে তারে আশার বাইরে তাকাইতে হবে। আমাদেরকে ভালো এবং খারাপের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। এবং এইটা করতে গেলে আমাদেরকে যা দিয়া শুরু করতে হবে সেইটা হইলো, “amor fati”.

এই amor fati টার্মটা আসছে ল্যাটিন ভাষা থাইকা। এর অর্থ হইলো “অদৃষ্টের ভালোবাসা”। অর্থাৎ নিয়তি আপনারে যা দেয় সেইটা খুশি মনে মাইনা নেওয়া।

এহহ!! নিয়তি! কথাটা শুনতেই কেমন কুসংস্কারপূর্ণ মনে হইতেছে! আপাতত মনরে এইটা মনে করতে দেন।

নিৎশের উপলব্ধি আমাদেরকে বলে, “অ্যামোর ফাতিঃ আমি কুৎসিতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চাই না। আমি কোন কিছু নিয়া অভিযোগ করতে চাই না, এমনকি যারা অভিযোগ করে তাদের বিরুদ্ধেও আমি অভিযোগ করতে চাই না।“

নিৎশে তাঁর এই কথা দিয়া যা বলতেছেন তা হইলো, জীবনরে এবং জীবনের সকল অভিজ্ঞতারে শর্তহীন ভাবে মাইনা নিতে, জীবনের উথান আর পতনরে মাইনা নিতে, জীবনের অর্থ আর অর্থহীনতারে মাইনা নিতে, নিজের যন্ত্রণারে ভালোবাসতে, নিজের দুঃখের সাথে প্রেম করতে, আকাঙ্ক্ষা আর বাস্তবতার মধ্যে দূরত্ব কমাইয়া আনতে এবং কেবল বাস্তবতারেই আকাঙ্ক্ষা করতে।

নিৎশে আরও বলছেন ‘কোন কিছুরই আশা কইরো না। ইতিমধ্যে যা আছে সেটাই গ্রহণ করো। কারণ আশা হইলো সারহীন। তোমার মন যা কিছুই কনসেপচুয়ালাইজ করে (আশা করে) সেইটা মূলত ত্রুটিযুক্ত ও সীমিত, এবং তোমার মনরে যদি তুমি এই ক্ষেত্রে পুজা করো তাইলে সেইটা তোমার জীবনরেও লিমিটেড কইরা তুলবে। বেশি সুখের আশা কইরো না। দুঃখরে কমাইতে চাইও না। নিজের চরিত্রের উন্নতি সাধনের আশা কইরো না। নিজের সব খুত মুইছা ফেলার আশা কইরো না।

বরং প্রতিটা সিঙ্গেল মুহূর্তের অন্তহীন সম্ভাবনা এবং কষ্টরে গ্রহণ করো। যন্ত্রণার ভিতর থাইকা যে স্বাধীনতার আবির্ভাব হয় সেইটা গ্রহণ করো। সুখের ভিতর থাইকা যে কষ্ট আসে সেইটা গ্রহণ করো। অজ্ঞতার মধ্য থাইকা যে প্রজ্ঞা আসে সেইটা গ্রহণ করো। সমর্পণের মধ্য থাইকা যে শক্তির উদয় হয় সেইটা গ্রহণ করো।‘

সর্বোপরি, জীবনের মূল শক্তির কাছে বিলীন কইরা দেও নিজের অহংরে। আশান্বিত হও – আশাহীন আশায়।

জুন ১০, ২০১৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *