স্বপ্নান্তর

মধ্যরাত। সিগারেট টানছি। ধোঁয়া ছাড়ছি। টানা আর ছাড়ার মাঝখানে প্রতিবারই সিগারেটটা ছাইদানির মুখের কাছে নিয়া তর্জনী দিয়ে টোকা দিচ্ছি। সিগারেট খাওয়ার সময় এতবার টোকা দেয়ার কোন দরকার নেই। কিন্তু আমি দেই। এটা আমার অভ্যাস। এই অভ্যাস আমার ছাড়তে ইচ্ছা করে না।

সিগারেটে কোন স্বাদ নেই। বিস্বাদ লাগছে। তবুও টেনে যাচ্ছি। আসলে সিগারেটে কখনই কোন স্বাদ ছিল না। তবে ক্ষণে ক্ষণে সিগারেটের ধোঁয়ায় একটা বিমূর্ত অনুভূতি টের পাওয়া যায়। সেজন্যই বোধয় বেশীরভাগ সময় স্বাদ না লাগলেও টানার অভ্যাসটা ছাড়তে পারিনি।

সিগারেটটা টানছি বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে। ডান হাতের উপর মাথাটা রাখা। বাহির থেকে আবছা আলো আসছে ঘরে। ঘরটা লম্বাটে। বড়। আমি ছাড়াও আরও দুজন থাকে এখানে। ব্যচেলর। আজকে ওরা নেই। আমি একা। মূলত পুরো ফ্ল্যাটেই আজকে আমি একা। পাশের ঘরের ওরাও গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গেছে। আমারও গ্রামের বাড়ি আছে। আমি যাই না।

ঘরে আমার বিপরীতে যে বিছানাটা আছে সেটার উপর একটা শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছি। চোখের সামনে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাচ্ছে। এরই মধ্যে আমি এক মুহূর্তের জন্য চোখ বুঝেছি। চোখ খুলে দেখি সামনের খালি বিছানাটায় একজন লোক শুয়ে আছে।

লোকটিকে দেখে আমি মোটেও চমকাইনি। আচমকা এই রাতে একটা লোক কোথেকে আসলো এমন প্রশ্নও মনে জাগেনি। মনে হচ্ছিল ইনি বহুকাল যাবত এই বিছানায় শুয়ে আছেন আর আমি দেখে যাচ্ছি। কিছুক্ষন পর ভালো করে খেয়াল করলাম। হালকা আলোতেও আমার বুঝতে অসুবিধা হল না। যে বুদ্ধাকে আমি জীবনভর খুঁজছি ইনিই সেই বুদ্ধা। এতদিন আমি তাঁকে দেখেও দেখিনি।

মুহূর্তেই আমার পুরো অস্তিত্বে একটা শিহরণ জেগে উঠলো। সিগারেটের মোথা ছাইদানিতে চেপে আমি লোকটার দিকে ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম। লম্বা রুম। ধীরে এগুচ্ছি। আমার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠছে। আনন্দে। কাছে গিয়ে বাতি জ্বালানোর জন্য সুইচবোর্ডে হাত বাড়ালাম। সুইচ চাপার সাথে সাথেই আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। আমি এতক্ষণ ডান কাত হয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। আর স্বপ্ন দেখছিলাম। বুদ্ধার সাথে কিছুই বলা হল না। যদিও স্বপ্ন তবুও কিছু একটা বলতে পারলে ভালো লাগত।

যাইহোক। কি আর করা। স্বপ্নতো স্বপ্নই। বিছানায় উঠে বসে একটা সিগারেট ধরালাম। ভাবছি কি একটা স্বপ্ন দেখলাম! সিগারেটে দু’টান দিতে দিতেই শুনতে পেলাম কয়েকজন নারীর গলার আওয়াজ। স্পষ্ট। আমার নিঃশ্বাসের মতই স্পষ্ট। এত রাতে এই ফ্ল্যাটে নারীর গলার আওয়াজ কিভাবে আসে। মনে হচ্ছে পাশের ঘর থেকে আসছে। উঠে দেখতে যাওয়ার জন্য দাঁড়ালাম। আবছা আলোয় নিচের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করলাম ফ্লোরের উপর অনেকগুলো যুবতি মেয়ে গাদাগাদি করে শুয়ে আছে। এবারে আমি চমকে উঠলাম। প্রতিটা মেয়েই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি দৌড় দিয়ে ডাইনিং রুমে যেতে চাইলাম। পারলাম না। মেয়েগুলো আমার পা জড়িয়ে ধরেছে। কি এক অদ্ভুত স্বরে ওরা গলা মিলিয়ে আওয়াজ করছে। মনে হল এটা সত্যি না আমি স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই তো আমার ঘুম ভাঙল।

এরই মধ্যে পাশের ঘর থেকে দুটো মহিলা আর একজন পুরুষ আসলো। সম্ভবত এই মহিলাদের গলাই প্রথমে শুনেছিলাম। পুরুষটার হাতে একটা জ্যান্ত কই মাছ। আমাকে জোর করে আস্ত মাছটা খাওয়াতে চাচ্ছে। ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমি খেতে চাচ্ছি না। কিছুক্ষন পর দেখলাম আরও অনেক মহিলা এবং পুরুষ এই ঘরে এসে প্রবেশ করছে। এত সব মানুষ কোথা থেকে এলো। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চারিদিক থেকে সবাই ঘিরে ধরেছে আমাকে। জ্যান্ত কই মাছ খাইয়ে ছাড়বে। জোর করে মুখ চেপে ধরে মাছটা যখন আমার মুখের কাছে নিয়ে এসেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে হল এই পুরো ঘটনাটা বাস্তব নয়। এটা মনে করাতেই স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো। জেগে উঠে হাঁপাচ্ছি। টের পেলাম আগেরবারের বুদ্ধার স্বপ্নের পরে আসলে আমার ঘুম ভাঙ্গেনি। আমি এক স্বপ্ন থেকে আরেক স্বপ্নে ঢুকে পড়েছিলাম। তবে এবার সত্যি সত্যি ঘুম ভেঙ্গেছে। এই যে এটাই তো আমার বর্তমান ঘর। স্বপ্নে যেটা দেখেছিলাম সেই ফ্ল্যাট ছেড়েছি বহু বছর আগে। হাতে ফোন নিয়ে দেখলাম রাত বাজে ৩:৩০। উঠে একটা সিগারেট ধরালাম। দুই টান দিয়েই মনে পড়ল ঘুমানোর আগে প্যাকেটে সিগারেট ছিল তিনটে। এখন হাতেরটা ছাড়া আর একটাও নেই। বাকি দুটো গেল কোথায়?

সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি আমি গ্রামের বাড়িতে। দুয়ারের কাছে বসে মা কই মাছ কুটছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *