লাইসেন্স

গাড়োয়ান আবু ছিলো খুবই কেতাদুরস্থ এবং তাঁর গাড়িটা ছিলো শহরের এক নম্বর গাড়ি। সে কেবল নিয়মিত যাত্রীদেরই তাঁর গাড়িতে নিতো। এখান থেকে তাঁর প্রতিদিন গড়ে আয় হতো দশ থেকে পনের রুপি, আর এই টাকাতেই তাঁর দিব্যি দিন চলে যেতো। অন্যসব গাড়োয়ানদের মত মদের প্রতি তাঁর কোন ঝোঁক ছিলো না, কিন্তু ফ্যাশনের প্রতি তাঁর একটা দুর্বলতা ছিলো।

যখনই তাঁর গাড়িটা পাশ কাটিয়ে যেতো, গাড়ির ঘণ্টার ঝনঝন আওয়াজে জায়গাটা মুখর হয়ে উঠতো, আশেপাশের সবগুলো চোখ ঘুরে তাকাতো তাঁর দিকে। ‘এই দেখো, কেতাদুরস্থ আবু যাচ্ছে। দেখো, তাঁর বসার ভঙ্গিটা দেখো। আর ঐ পাগড়ির আগাটা কেমন এক পাশে উল্টে আছে!’

আবু যখন এই কথাগুলো শুনতো আর লোকজনের চোখে তারিফের ছায়াটা নিরিখ করতো, তখন তাঁর মাথাটা উঁচু হয়ে যেতো আর তরান্বিত হতো তাঁর ঘোড়া চিন্নির পদক্ষেপ। আবু এমনভাবে তাঁর ঘোড়ার লাগামগুলো ধরে রাখতো, দেখে মনে হতো যেন এদেরকে ধরে রাখার তেমন কোন দরকারই নেই, যেন চিন্নি তাঁর মনিবের নির্দেশনা ছাড়াই চলতে পারে।

মাঝে মাঝে মনে হতো চিন্নি আর আবু দুজনেই যেন একজন, অথবা বরং পুরো গাড়িটাই যেন একটা একক জীবনীশক্তি, এবং কে সেই শক্তি, আবু ছাড়া?

যেইসব যাত্রীদেরকে আবু তাঁর গাড়িতে নিতো না, তাঁরা তাঁর দিকে কঠোর অভিশাপ ছুড়ে দিতো। কেউ কেউ তাঁর অনিষ্ট কামনা করতোঃ ‘ঈশ্বর যেন তাঁর অহমিকা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়, এবং সে আর তাঁর ঘোড়াটা যেন নদীতে গিয়ে পড়ে।’

মাটিতে, আবুর চিকন গোঁফের ছায়াটায়, একটা ঐশ্বরিক আত্মবিশ্বাসের মুচকি হাসি নেচে উঠতো। এটা দেখে অন্যসব গাড়োয়ানরা ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরতো। আবুর চেহারাটা দেখলেই তাঁদের মনে একটা প্রবল ইচ্ছা জেগে উঠতো — ভিক্ষা করে, ধার করে এবং চুরি করে যেভাবেই হোক তাঁরাও আবুর মত পিতলের সাজসরঞ্জাম দিয়ে তাঁদের গাড়িগুলো সাজাবে। কিন্তু তাঁরা আবুর অনন্য ধরন আর সৌন্দর্যকে কিছুতেই প্রতিলেপন করতে পারতো না। এমন অনুরক্ত যাত্রীও তাঁরা খুঁজে পেতো না।

এক বিকেলে, গাছের ছায়ায় আবু তাঁর গাড়ির উপর শুয়েছিলো, একটা গলার আওয়াজে তাঁর ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। আবু চোখ খুলে দেখলো একটা মহিলা নিচে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটার দিকে আবু অবশ্য একবারই তাকাতো, কিন্তু মহিলার অদম্য যৌবন তাৎক্ষনিক আবুর হৃদপিণ্ডটা ভেদ করে গেলো। সে আসলে মহিলা ছিলো না, সে ছিলো একটা মেয়ে —ষোল কিংবা সতের; ছিপছিপে গড়ন, কিন্তু মজবুত, এবং গায়ের রং কালো কিন্তু উজ্জ্বল। তাঁর কানে দুলছিলো দুটো রূপোর ঘের। তাঁর চুল গুলোকে দুভাগ করে রেখেছিলো মাঝখানের সিথিটা এবং তাঁর সরু নাকের ডগায় ছিলো একটা ছোট্ট, উজ্জ্বল সুন্দর দাগ। তাঁর পরনে ছিলো একটা লম্বা কুর্তা, একটা স্কার্ট আর মাথার উপরে ছিলো একটা পাতলা শাল।

মেয়েটা শিশুসুলভ কণ্ঠে বললো, “টেশানে যেতে তুমি কত নিবে গো?”

আবুর স্মিত ঠোঁটে দুষ্টামি খেলা করছিলো, “কিছুই না।”

মেয়ের কালো মুখটা আরক্ত হয়ে উঠলো, “টেশানে যেতে তুমি কত নিবে গো?” সে আবারো বললো।

আবু তাঁর চক্ষু দুটো মেয়েটার উপর বেশ কিছুক্ষণ নিবদ্ধ রেখে উত্তর দিলো, “তোমার কাছ থেকে কি নিতে পারি আমি, ভাগ্যবতী? যাও, গাড়ির পেছনে উঠে বসো।”

মেয়েটা কাঁপা হাতে তাঁর অবগুণ্ঠিত টানটান বক্ষ যুগল ঢেকে নিলো, “এসব কি বল তুমি!”

আবু মুচকি হাসলো, “যাও, উঠে পড়ো। তুমি যা দিবে আমি তাই নেবো।”

মেয়েটা এক মুহূর্ত ভেবে নিলো, তারপর পাদানিতে পা রেখে উঠে পড়লো গাড়িতে। “জলদি করো, তাহলে। আমাকে টেশানে নিয়ে যাও।”

আবু ঘুরে বললো, “খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে আছো, সুন্দরী?”

“তুমি……তুমি……।” মেয়েটা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু বাক্যের মাঝখানেই সে থেমে গেলো।

গাড়িটা চলতে শুরু করলো, এবং চলতেই থাকলো; ঘোড়ার খুরের নিচে পার হয়ে গেলো অনেক রাস্তা। মেয়েটা অস্বস্তি নিয়ে বসে রইলো পেছনে। একটা দুষ্ট হাসি নেচে উঠলো আবুর ঠোঁটের ডগায়। নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় পার হওয়ার পর মেয়েটা ভীত গলায় জিজ্ঞেস করলো, “টেশান এখনো আসেনি?”

আবুর অর্থবহ উত্তর, “আসবে। তোমার আর আমার তো একই টেশান।”

“এই কথার মানে কি?”

আবু ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটার হাতের উপর চোখ রেখে বললো, “তুমি এমন বালাভোলা নও, নিশ্চয়ই? তোমার আর আমার টেশান সত্যিই এক। প্রথম যখন তোমার উপর চোখ রেখেছি, তখনই তা এক হয়ে গেছে। তোমার জীবনের দিব্যি দিয়ে বলছি, আমি তোমার গোলাম, আমি মিথ্যা বলব না।”

মেয়েটা তাঁর মাথার শালটা ঠিক করে নিলো। তাঁর চোখ বলছিলো সে আবুর কথার অর্থ ধরতে পেরেছে। তাঁর মুখ বলছিলো আবুর কথাগুলোকে সে খারাপভাবে নেয়নি। কিন্তু সে একরকম উভয়সঙ্কটে পড়ে গেলোঃ আবু আর তাঁর ষ্টেশন হয়তো একই হবে; আবু লোকটা বুদ্ধিমান আর সুবেশী, কিন্তু সে কি বিশ্বস্ত? এখন কি উচিত হবে আবুর জন্যে তাঁর ষ্টেশনের আশা ত্যাগ করা, যদিও তাঁর ট্রেন অনেক আগেই ষ্টেশন ছেড়ে চলে গেছে?

আবুর কণ্ঠ তাঁর কানে বাজলো, “কি ভাবছো তুমি, ভাগ্যবতী?”

ঘোড়াটা সানন্দে লাফিয়ে চলছিলো; বাতাসটা ছিলো ঠাণ্ডা; রাস্তার দুপাশে গাছগুলো সারিবেধে ছুটছিলো; আবছা হয়ে গিয়েছিলো তাঁদের ডালপালা; নিঃশব্দ চারিদিক, কেবল ঘণ্টার ঝনঝন আওয়াজ। আবু, উঁচু শিরে, বিভোর হয়ে ডুবেছিলো মেয়েটাকে চুমু খাওয়ার দিবাস্বপ্নে। কিছুক্ষণ পর, আবু তাঁর ঘোড়ার লাগামগুলো বেঁধে নিলো ড্যাশবোর্ডে এবং লাফিয়ে পেছনের সিটে মেয়েটার পাশে গিয়ে বসলো। মেয়েটা নিশ্চুপ। আবু মেয়েটার হাত দুটো ধরলো। “তোমার সবকটি লাগাম রাখো আমার হাতে!”

মেয়েটা শুধু দুটো শব্দই উচ্চারণ করলো। “যথেষ্ট হয়েছে।” কিন্তু আবু তাৎক্ষনিক দুহাতে তাঁকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা বাধা দিলো। তাঁর হৃদপিণ্ডের ধুকধুকানি এতই বেড়ে গেলো, যেন এটা তাঁকে ছেড়ে উড়ে চলে যেতে চাইছিলো।

“এই ঘোড়া আর এই গাড়িটাকে আমি আমার জীবনের চাইতেও বেশী ভালোবাসি,” আবু একটা নরম, আদুরে গলায় বললো, “কিন্তু একাদশী পীরের কসম, আমি এটা বিক্রি করে দিয়ে তোমাকে সোনার বালা গড়ে দিবো। আমি নিজে পুরনো, ছেড়া কাপড় পড়ে থাকবো, কিন্তু তোমাকে আমি রাজকুমারীর মত করে রাখবো! আমি সর্বব্যাপী খোদার দোহাই দিয়ে বলছি, এটাই আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। তুমি যদি আমার না হও, তোমার সামনে, এই মুহূর্তেই আমি ছুরি চালাবো আমার গলায়।” তারপর হঠাৎ, আবু মেয়েটার কাছে থেকে সরে গেলো। “জানিনা, আজ আমার কি হয়েছে। চলো, তোমাকে টেশানে নামিয়ে দিয়ে আসি।”

“না” মেয়েটা নরম গলায় বললো, “তুমি তো আমায় ছুঁয়ে ফেলেছো।”

আবু তাঁর মাথাটা নোয়ালো। “দুঃখিত। আমার ভুল হয়ে গেছে।”

“আর তুমি কি এই ভুলটাকে সম্মান জানাবে?”

মেয়েটার কণ্ঠে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলো, কেউ যেন আবুকে বললো, “দেখি, তোমার গাড়িটা আমারটার আগে যেতে পারে কিনা।” আবু তাঁর নিচু মাথাটা উঁচু করলো; তাঁর চোখ গুলো চকচক করছিলো। “ভাগ্যবতী……” বলেই সে নিজের বুকের উপর হাত রেখে বললো, “আবু তাঁর জীবন দিয়ে দিবে।”

মেয়েটা তাঁর হাতটা বাড়িয়ে দিলো। “তাহলে আমার হাত ধরো।”

আবু তাঁর হাতটা শক্ত করে ধরলো। “আমার যৌবনের কসম। আবু তোমার গোলাম।”

পরের দিন দুজনে বিয়ে করলো। মেয়েটা ছিলো গুজরাটের, তাঁর বাবা পেশায় একজন মুচি; মেয়েটার নাম ছিলো নেস্তি। সে শহরে এসেছিলো আত্মীয়দের সাথে। তাঁর আত্মীয়রা তখনো ষ্টেশনে বসে অপেক্ষা করছিলো, যখন আবু আর সে একে অপরের প্রেমে পড়ছিলো।
তাঁরা দুজনেই ছিলো খুব সুখী। আবু তাঁর ঘোড়া কিংবা গাড়ি কোনটাই বিক্রি করেনি, নেস্তির জন্যে সোনার বালাও গড়েনি, কিন্তু সে তাঁর জমানো সমস্ত টাকা খরচ করে নেস্তির জন্যে সোনার মাকড়ি আর রেশমি কাপড় কিনে এনেছিলো।

খসখস শব্দে রেশমি স্কার্টটাকে এপাশ ওপাশ ঘুরিয়ে নেস্তি যখন আবুর সামনে এসে দাঁড়াতো, তাঁর হৃদপিণ্ডটা নেচে উঠতো। “আমি শপথ করে বলতে পারি, তোমার মত সুন্দরী পৃথিবীতে আর কেউ নাই।” এটা বলেই সে নেস্তিকে তাঁর বুকের সাথে চেপে ধরতো। “তুমি আমার হৃদয়ের রানী।”

দুজনেই যৌবনের সুখে আকণ্ঠ ডুবে গিয়েছিলো। তাঁরা গাইতো, হাসতো, ঘুরে বেড়াতো; তাঁরা একে অন্যের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলো বিশ্বস্ততায়।

এমন করেই কেটে গেলো পুরো এক মাস, হঠাৎ একদিন সকালে পুলিশ এসে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো আবুকে। তাঁর নামে একটা অপহরণের মামলা ঠুকে দেয়া হয়েছিলো। নেস্তি আবুর পাশে গিয়ে অনড় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছিলো তাঁর নির্দোষতা, কিন্তু তা সত্ত্বেও, আবুর দুই বছরের জেল হলো। আদালত যখন রায় ঘোষণা করেছিলো, নেস্তি আবুকে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিলো। “আমি বাবা-মার কাছে কখনই ফিরে যাবো না,” নেস্তি কাঁদতে কাঁদতে বললো। “আমি বাড়িতে বসে তোমার জন্যে অপেক্ষা করবো।”

আবু আলতো করে নেস্তির পেটে হাত রাখলো। “তোমায় আশীর্বাদ করি। দিনুকে আমি ঘোড়া আর গাড়িটা দিয়েছি। তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত ভাড়াটা নিয়ে নিও।”

নেস্তির বাবা মা অনেক চাপ দেওয়া সত্ত্বেও সে তাঁদের কাছে ফিরে যায়নি। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে তাঁরা তাঁকে পাওয়ার আশা ছেড়েই দিলো। নেস্তি একা বাস করা শুরু করলো। দিনু প্রতি সন্ধ্যায় তাঁকে পাঁচ রুপি করে দিতো যা দিয়ে তাঁর সব খরচাপাতি হয়ে যেতো। আদালতের মামলা থেকে পুঞ্জিভূত টাকাটাও সে পেয়েছিলো।

জেলখানায় সপ্তাহে একবার আবু আর নেস্তি দেখা করতো, সাক্ষাত গুলোকে তাঁদের কাছে খুবই সংক্ষিপ্ত মনে হতো। যতটুকু টাকা নেস্তি জমিয়েছিলো, সবটুকুই সে জেলখানায় আবুর স্বাচ্ছন্দ্য আনয়নে ব্যয় করতে লাগলো। এক সাক্ষাতকালে, আবু নেস্তির কানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তোমার মাকড়ি গুলো কোথায়, নেস্তি?”

নেস্তি মুচকি হাসলো, আর প্রহরীর দিকে তাকিয়ে বললো, “নিশ্চয়ই কোথাও হারিয়ে ফেলেছি।”

“আমাকে এত যত্ন-আত্মি করা তোমার প্রয়োজন নেই,” আবু একটু রাগের গলায় বললো, “যেমনই আছি, আমি ভালো আছি।”

নেস্তি কিছুই বললো না। তাঁদের সময় শেষ হয়ে গেলো। নেস্তি হাসিমুখে বিদায় নিলো, কিন্তু বাড়ি পৌঁছে সে প্রচুর কান্নাকাটি করলো, সে কয়েক ঘণ্টা ধরে কাঁদলো, কারণ আবুর শরীরের দিন দিন অবক্ষয় হচ্ছিলো। শেষ সাক্ষাতে, সে আবুকে প্রায় চিনতেই পারছিলো না। স্বাস্থ্যবান সেই আবু যেন হারিয়ে গেছে। নেস্তি ভাবলো তাঁদের বিচ্ছেদের বিষাদটা হয়তো আবুকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, আর এই জন্যেই তাঁর স্বাস্থ্যের এমন অবনতি। নেস্তি জানতো না যে আবু টিবিতে আক্রান্ত, এবং এই রোগ তাঁর পরিবারে চলে আসছিলো। আবুর বাবা আবুর চেয়েও শক্তসবল ছিলো, কিন্তু টিবি তাঁকে অল্প বয়সেই কবরে পাঠিয়েছিলো। আবুর বড় ভাইও ছিলো একজন বলিষ্ঠ যুবক, কিন্তু এই রোগ যৌবনেই তাঁকে নিঃশেষ করে দিয়েছিলো। আবু নিজেও তাঁর রোগের কথা জানতো না। জেলখানার হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় আবু দুঃখ ভারাক্রান্ত গলায় নেস্তিকে বলেছিলো, “যদি জানতাম আমি এত তাড়াতাড়ি মরে যাবো, খোদার কসম, আমি তোমাকে আমার বউ বানাতাম না। তোমার উপর বড় অবিচার করে ফেলেছি। আমায় মাফ করে দিও। আর শোন, ঘোড়া আর গাড়িটা হলো আমার হলমার্ক। তাঁদের যত্ন নিও। চিন্নির মাথায় একটা চাপড় মেরে বলো, আবু তাঁর ভালোবাসা পাঠিয়েছে।”

নেস্তিকে নিঃসঙ্গ করে দিয়ে আবু মরে গেলো। কিন্তু নেস্তি খুব সহজেই হার মানার মত মহিলা ছিলো না। সে তাঁর শোককে প্রতিরোধ করলো। বাড়িটা এখন জনমানব শূন্য। সন্ধ্যাগুলোতে দিনু এসে তাঁকে সান্তনা দিতো, “ভঁয় নেই, ভাবি। খোদার আগে কেউ পা বাঁড়াতে পারে না। আবু ছিলো আমার ভাই। তোমার জন্য আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব, খোদার ইচ্ছায়, আমি সবই করবো।”

প্রথমে নেস্তি বুঝতে পারেনি, কিন্তু তাঁর শোকের সময়টা যখন পার হলো, দিনু পরিষ্কার ভাষায় বলে দিলো সে নেস্তিকে বিয়ে করতে চায়। এই কথা শোনার পর নেস্তি তাঁকে বাড়ি থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে চাইলো, কিন্তু সে তা করলো না, শুধু বললো, “দিনু, আমি আর বিয়ে করতে চাই না।”

সেই দিন থেকে, নেস্তিকে দেয়া দিনুর রোজকার রুপিতে একটা পার্থক্য তৈরি হলো। আগে, প্রতিদিনই দিনু পাঁচ রুপি করে দিতো। কিন্তু এখন সে মাঝে মাঝে চার, মাঝে মাঝে তিন রুপি করে দেয়া শুরু করলো। ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না বলে সে অজুহাত দেখাতো। তারপর সে একেকবার দুই-তিন দিন করে অদৃশ্য হওয়া শুরু করলো। মাঝে মাঝে সে অসুস্থতার কথা বলতো; অন্যসময় বলতো যে গাড়ির কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে এবং সে সেটা বের করে আনতে পারছে না। একদিন সে খুব বাড়াবাড়ি করায় নেস্তি বললো, “শোন, দিনু, এটা নিয়ে আর সমস্যা বাঁধিও না। ঘোড়া আর গাড়িটা আমার কাছে হস্তান্তর করো।”

অনেক গড়িমসির পর, দিনু শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়ে নেস্তির হাতে ঘোড়া আর গাড়িটা ফিরিয়ে দিলো। নেস্তি গাড়িটা নিয়ে আবুর বন্ধু মাজাকে দিলো। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে, মাজাও তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। নেস্তি যখন তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলো, মাজার চোখের রংটা পাল্টে গিয়েছিলো; চোখগুলো তাঁর শীতল হয়ে উঠেছিলো। নেস্তি তাঁর কাছ থেকে ঘোড়া আর গাড়িটা ফিরিয়ে নিয়ে একজন অচেনা গাড়োয়ানের কাছে দিলো। সেই গাড়োয়ান সব সীমা পরিসীমা অতিক্রম করে ফেললো , সম্পূর্ণ মাতাল হয়ে একদিন সে নেস্তিকে টাকা দিতে আসলো, নেস্তি দরজা দিয়ে বের হতেই সে তাঁকে জড়িয়ে ধরতে গেলো। নেস্তি তাঁকে সেই মুহূর্তেই চাকরীচ্যুত করলো।

প্রায় আট থেকে দশদিন, গাড়িটা আস্তাবলে পড়ে রইলো, বেকার, খরচ বেড়েই যাচ্ছিলো— একদিকে ঘোড়ার খাওয়া, অন্যদিকে আস্তাবলের ভাড়া। নেস্তি দ্বিধায় পড়ে গেলো। মানুষ তাঁকে হয় বিয়ে করার চেষ্টা করছিলো, অথবা ধর্ষণ করতে চাইছিলো, নয়তো ডাকাতি করতে চাইছিলো। সে যখনই বাইরে বের হতো, লোকজন তাঁর দিকে কুৎসিত নজরে চেয়ে থাকতো। এক রাতে এক প্রতিবেশী বাড়ির প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে এসে তাঁকে বায়না করা শুরু করলো। এখন তাঁর কি করা উচিত এটা ভেবেই নেস্তি প্রায় আধা পাগল হয়ে গেলো।

একদিন বাড়িতে বসে সে ভাবলো, “যদি আমি নিজেই গাড়িটা চালানো শুরু করি তাহলে কেমন হবে?” যখন সে আবুর সাথে ঘুরতে বের হতো, প্রায়ই সে নিজে গাড়িটা চালাতো। সে সবগুলো রাস্তার সাথেও পরিচিত ছিলো। তারপর তাঁর মনে আসলো লোকে কি ভাববে সে কথা। তাঁর মনে অনেক ধরনের প্রত্যুত্তর আসলো। “ক্ষতি কি? মহিলারা কি কঠোর পরিশ্রম করে না? এখানে মহিলারা খনিতে কাজ করছে, ওখানে অফিসে, হাজারো মহিলা কাজ করছে বাড়িতে; তোমাকে পেট ভরতে কোন না কোন পন্থা অবলম্বন করতেই হবে!”

ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে সে কয়েকদিন কাটিয়ে দিলো। অবশেষে গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্তটা সে নিয়েই নিলো। তাঁর বিশ্বাস ছিলো যে সে পারবে। সুতরাং, ঈশ্বরের নাম নিয়ে এক সকালে সে আস্তাবলে চলে গেলো। ঘোড়াটাকে সাজিয়ে সে যখন গাড়ির সাথে জুড়ে দিচ্ছিলো, অন্যসব গাড়োয়ানরা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো, কেউ কেউ এটাকে কৌতুক মনে করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। বয়স্ক গাড়োয়ানটা তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলো, বললো যে মেয়েদের এই কাজ শোভা পায় না। কিন্তু নেস্তি এই কথা শুনবে না। সে গাড়িটাকে ঠিকঠাক মত লাগালো, পিতলের সরঞ্জামগুলো ঝেড়ে মুছে নিলো, এবং ঘোড়াটাকে গভীর মমত্ব দেখিয়ে, আবুকে উদ্দেশ্য করে কিছু স্পর্শকাতর কথা বলে, সে আস্তাবল থেকে যাত্রা শুরু করলো। নেস্তির নৈপুণ্য দেখে অন্য সব গাড়োয়ানরা স্তব্ধ হয়ে গেলো, সে গাড়িটাকে খুব দক্ষতার সাথেই সামলেছিলো।

সারা শহরে কথা ছড়িয়ে গেলো যে একটা সুন্দরী মহিলা গাড়ি চালাচ্ছে। প্রতিটা রাস্তার মোড়ে মানুষ এই নিয়েই কথা বলছিলো। সবাই অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো কখন নেস্তির গাড়ি তাঁদের রাস্তায় নেমে আসবে।

প্রথম দিকে নেস্তি লজ্জায় পুরুষ যাত্রীদেরকে এড়িয়ে চলতো, কিন্তু শীঘ্রই তাঁর লজ্জাটা কেটে গেলো এবং সে মোটা অংকের টাকা আয় করা শুরু করলো। তাঁর গাড়ি কখনই বেকার বসে থাকতো না, এখানে যাত্রী নামে তো সেখানে যাত্রী উঠে। মাঝে মাঝে কে আগে থামিয়েছে এ নিয়ে যাত্রীদের মাঝে ঝগড়া বেঁধে যেতো।

কাজের পরিমাণ যখন খুব বেড়ে গেলো, তখন তাঁকে গাড়ি বের করার নির্দিষ্ট সময় বের করে নিতে হয়েছিলো—সকালে, সাতটা থেকে বারোটা; বিকেলে, দুইটা থেকে ছয়টা। এই আয়োজনটা বেশ লাভজনক বলে প্রমাণিত হলো, কারণ এতে সে যথেষ্ট বিশ্রাম নিতে পারতো। চিন্নিও এতে খুশি হলো, কিন্তু নেস্তি বুঝতে পারছিলো যে তাঁর বেশীরভাগ যাত্রীই কেবল একটু তাঁর কাছে বসার জন্যেই তাঁর গাড়িতে চড়ে। তাঁরা তাঁকে উদ্দ্যেশ্যহীনভাবে এখান থেকে ওখানে নিয়ে যেতে বলতো, মাঝে মাঝে পেছন থেকে নোংরা কৌতুক করতো। তাঁরা নেস্তির সাথে কথা বলতো কেবল তাঁর কণ্ঠের আওয়াজটা শোনার জন্যেই। যদিও সে নিজেকে বিক্রি করেনি, তবুও মাঝে মাঝে তাঁর মনে হতো মানুষ যেন তাঁকে গোপনে কিনে নিয়েছে। সে এও জানতো যে শহরের অন্যসব গাড়োয়ান তাঁর সম্পর্কে খারাপ মনোভাব পোষণ করে। কিন্তু সে ছিলো অবিচল, নিজের উপর বিশ্বাসটা তাঁকে শান্তিতে রেখেছিলো।

একদিন সকালে, পৌরসভা কমিটির লোকেরা তাঁকে ডেকে নিয়ে তাঁর লাইসেন্সটা বাতিল করে দিলো। কারণ হিসেবে তাঁরা বললো, নারীদের গাড়ি চালানো নিষেধ। নেস্তি জিজ্ঞেস করলো, “স্যার, কেনো নারীরা গাড়ি চালাতে পারবেনা?”
উত্তর এলো, “তাঁরা পারবে না, ব্যাস। তোমার লাইসেন্স বাতিল।”

নেস্তি বললো, “স্যার, দরকার হয় আমার ঘোড়া আর গাড়িটাও নিয়ে নিন, কিন্তু তারপরও আমাকে বলুন কেন নারীরা গাড়ি চালাতে পারবে না। নারীরা জাঁতা পিষে পেটের খাবার যোগার করতে পারে। নারীরা পাথরের ঝুড়ি মাথায় বয়ে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। নারীরা কয়লার খনিতে খেটে প্রতিদিনকার রুটি যোগার করতে পারে। আমি কেন একটা গাড়ি চালাতে পারবো না? আমি এই গাড়ি চালানো ছাড়া আর কিছুই জানি না। আমার স্বামী ঘোড়া আর গাড়িটা রেখে গিয়েছে, আমি কেন তাঁদের ব্যবহার করতে পারবো না? আমি কি করে বাঁচবো? হে খোদা, দয়া করুন। কেন আপনারা আমার সততা আর কঠোর পরিশ্রমে বাধা দিচ্ছেন? আমি কি করবো? বলুন আমায়।”
অফিসার উত্তর দিলোঃ “বাজারে গিয়ে নিজের জন্যে একটা জায়গা খুঁজে নাও। তুমি নিশ্চিত ঐ পন্থায় আরও ভালো আয় করতে পারবে।”

কথাটা শুনে, সত্যিকারের নেস্তি, ভিতরের আসল মানুষটা, একেবারে ধুলোয় মিশে গেলো। “জী, স্যার,” সে নরম গলায় উত্তর দিয়ে বের হয়ে গেলো। সে ঘোড়া আর গাড়িটাকে যা পেল সে দামেই বিক্রি করে দিয়ে সোজা আবুর কবরে চলে গেলো। কবরের পাশে এক মুহূর্ত সে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁর চোখগুলো ছিলো সম্পূর্ণ শুকনো, যেন অগ্নিশিখা, শুষে নিচ্ছে মাটির সকল সিক্ততা। তাঁর ঠোঁটগুলো নড়ে উঠলো, সে কবরের দিকে তাকিয়ে বললো, “আবু, তোমার নেস্তি আজ সকালে কমিটি অফিসে মারা গেছে।”

এটা বলেই সে সেখান থেকে চলে গেলো। পরের দিন সে তাঁর আবেদনপত্র জমা দিলো। তাঁকে দেয়া হলো একটা দেহ বিক্রির লাইসেন্স।

মূলঃ লাইসেন্স—সাদাত হাসান মান্টো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *