মুভি ওয়েকিং লাইফ (২০০১)—একটা ফিলসফিকাল থেরাপি

যেহেতু আপনি এই রিভিও পড়া শুরু করছেন তাই বলা যায় যে আপনি একজন দার্শনিক। তবে যারা এই রিভিও পড়া শুরু করে নাই অথবা ভবিষ্যতে পড়ারও কোন সম্ভাবনা নাই তাঁরাও দার্শনিক। তাইলে আপনার আর তাঁদের মধ্যে পার্থক্য কি রইল? পার্থক্য এইডাই, আপনি পড়ছেন আর তাঁরা পড়ে নাই! অন্য কোন পার্থক্য তৈরি হইতেও পারে আবার নাও পারে। আসল কথা হইলঃ সবাই দার্শনিক। অন্তত বিংশ শতাব্দীর শক্তিশালী দার্শনিক কার্ল পপারের মতে দুনিয়ার শিক্ষিত আর অশিক্ষিত প্রতিটা মানুষই দার্শনিক, তাদের মধ্যে কেউ কেউ জানে যে তাঁরা দার্শনিক আর বাকিরা তা জানে না। আমি এই ভদ্রলোকের সাথে এই বিষয়ে একমত না হইয়া থাকতে পারি নাই। কারণ শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিত হোক প্রত্যেকেরই নিজের একটা জীবন দর্শন আছে, নিজের না থাকলেও অন্যের অথবা সমাজের অথবা ধর্মের কাছ থেকে ধার করা জীবন দর্শনকে নিজের মত ফিল্টার কইরা নিয়া সেই দর্শনের উপর ভঁর কইরা মানুষ জীবন চালাইতে থাকে। দর্শন ছাড়া জীবন চলে না। তবে সাধারণ আর অতি সাধারণ মানুষের বেশিরভাগই এই বিষয়টা জানে না। আর জানলেও তাঁরা নিজেরে দার্শনিক ভাবতে হয় সাহস করে না, নয়তো আরাম বোধ করে না। আপনি জানা আর না জানা যেই দলেরই হন, যেহেতু আপনি দার্শনিক তাই দর্শন ভিত্তিক মুভি ওয়েকিং লাইফ (২০০১) দেখাটা আপনের জন্যে অতীব প্রয়োজনীয় (দেখার পর আপনার কাছে অপ্রয়োজনীয় মনে হইতেও পারে, তবে সেই মনে হওয়াটাও হবে আপনার নিজের দর্শন)। এখন প্রশ্ন হইল আপনি দার্শনিক নাকি দার্শনিক না, জীবন ধারণের জন্যে এই বিষয়টা জানা কতটা জরুরী? টেকনিক্যালি স্পিকিং— এইটা জানার কোন দরকারই নাই। কারণ জীবন ধারণের আসল উদ্দেশ্য হইল জীবনকে উপভোগ করা, দর্শন কপচানো না। কিন্তু সমস্যা হইল জীবনকে আপনি উপভোগ করতে পারবেন না, যদি না আপনি জেগে থাকেন। এবং দুঃখের বিষয় হইল বেশীরভাগ মানুষই পুরো জীবনটা কাটাইয়া দেয় ঘুমের মধ্যে। তাঁরা জানে না যে তাঁরা ঘুমাইতেছে। খালি যতক্ষণ বিছানায় শুইয়া চোখ বুইজা অজ্ঞান হইয়া থাকে ঐ সময়টারেই ঘুমানো মনে করে। আর ভাবে যে বাকি সময়টা সে জাইগা আছে। এইটারে বলা হয় ‘ফলস এওয়েকেনিং’ অর্থাৎ মিথ্যা জাগরণ। আপনি যদি এইরকম ঘুমের মধ্যে থাকেন তাইলে আপানারে জাগানোর জন্যে দরকার দর্শন। আর আপনি যেহেতু ইতিমধ্যেই একজন দার্শনিক, তাই আপনার প্রয়োজন নিজের দর্শন সম্পর্কে সজাগ হওয়া, জীবন সম্পর্কে সজাগ হওয়া। দর্শনের বিভিন্ন এঙ্গেল থাইকা খোঁচাইয়া আপনারে ঘুম থাইকা জাগানোর চেষ্টা করবে এই মুভিটা।

m_sharif-1459938343-9bc7bdd_xlarge

মুভিটারে বলা হয় “এডালট এনিমেটেড ডকুফিকশন”। তবে মুভিটা পুরোপুরি এনিমেশন না। অর্থাৎ মুভিতে রিয়েল ক্যারেকটার ব্যবহার করা হইছে। কিন্তু সেইটা মুভি দেখার সময় বোঝা যায় না। মনে হয় এনিমেশন। একটা মুভিরে এইরকম করাটাকে বলা হয় “রোটস্কোপ”। মুভি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আপনি ঢুইকা পড়বেন একটা ড্রিম লাইক রিয়েলিটিতে। মুভিতে একটা কেন্দ্রীয় পোলা আছে। মুভি দেইখা পোলাডার নাম জানা যায় নাই। নাম ছাড়া এই পোলাডার সাথে আপনি স্বপ্ন আর বাস্তবতার মাঝামাঝি একটা জগতে ঘুইরা বেড়াইবেন পুরা মুভিতে। আপনার সাথে দেখা হইব বিভিন্ন সেলিব্রেটেড ইনটেলেকচুয়াল ব্যক্তিত্বের, কথাও হইব। যতজন বুদ্ধিজীবীর সাথে কথা হইব, তাঁদের প্রত্যেকের দর্শন ভিন্ন রকম। কারো সাথে কারো কথার কোন মিল নাই। কিন্তু প্রত্যেকেই ভিন্ন এঙ্গেল, ভিন্ন ফিল্ড আর ভিন্ন ডাইমেনশন থাইকা কথা বললেও উনাদের সবার কথাই একটা সিঙ্গেল পয়েন্টের দিকে ছুটে। সবাই যেন একই কথা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বলতে চায়! মুভিতে কেন্দ্রীয় পোলার এঙ্গেজমেনট ছাড়াও আরও কিছু দৃশ্য আছে যেখানে গুরুত্বপূর্ণ দর্শনের প্রতিফলন ঘটে।

মুভিটারে এনিমেটেড লুক দিয়া তৈরি করার পেছনে যেই কারণটা থাকতে পারে সেইটা হইল একটা দার্শনিক এঙ্গেল থাইকা মনে করা হয় এই দুনিয়াটাও একটা এনিমেটেড দুনিয়া। অর্থাৎ আপনি আর আমি প্রতিদিন যে রিয়েলিটি এক্সপেরিয়েন্স করি তা সত্যি না। কথাডা মানতে আপনের কষ্ট হইতে পারে। কিন্তু শুধু দার্শনিক না, কিছু বিজ্ঞানীও আজকাল এই সুরে কথা কয়। কগনিটিব সাইন্টিস্ট হফম্যান তাঁদের মধ্যে একজন। মুভির কাহিনী কিছুদূর আগানোর পর এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় পোলাডা অনুধাবন করে সে আসলে জাইগা নাই। ঘুমের মধ্যে আছে। বিষয়টা এমন, ধরেন আপনি ঘুমাইলেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন। সেইটা সুখের স্বপ্নও হইতে পারে আবার দুঃস্বপ্নও হইতে পারে। স্বপ্ন দেইখা আপনি জাইগা উঠলেন। যা দেখছেন তা নিয়া কিছুক্ষণ ভাইবা রেগুলার লাইফে ফিরা গেলেন। রাইতে আবার ঘুমাইলেন আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন। আবার জাগলেন। আবার রেগুলার লাইফে ফিরা গেলেন। এভাবে এক পর্যায়ে আপনি টের পাইলেন যে আপনি যতবার জাগছেন ওইটা আসলে ‘মিথ্যা জাগরণ’। অর্থাৎ আপনি স্বপ্ন দেখতাছেন যে আপনি ঘুমাইতেছেন আর জাগতেছেন। এইটারে বলা হয় ‘পারপেচুয়াল ড্রিমিং’। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর! মুভির কেন্দ্রীয় পোলাডা এই রকম একটা স্বপ্নে আটকা পইড়া যায়। ঘুম থাইকা জাগার জন্যে স্বপ্নের মধ্যেই সে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর সাথে দেখা কইরা তাঁদের দর্শন তত্ত্ব শুনে।

m_sharif-1459938380-e7ae0db_xlarge

মুভিতে তুইলা ধরা দর্শন তত্ত্বের প্রধান ইস্যু গুলা হইল মেটাফিজিক্স, ফ্রি উইল, সোশ্যাল ফিলসফি আর মিনিং অব লাইফ। অস্তিত্ববাদের স্পর্শও আপনি এই মুভিতে পাইবেন। আপনি দর্শন প্রেমী হইলে তো কোন কথাই নাই। এই মুভি আপনার কাছে অতীব ইন্টারেস্টিং ঠেকবো এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু আপনি যদি দর্শন প্রেমী না হইয়া থাকেন, এই মুভি দেখতে গিয়া আপনার মাথায় হাল্কা অথবা ভারী ধরনের একটা চাপ পড়তে পারে। কিন্তু আপনি দর্শন প্রেমী না হইলেও আপনি তো দার্শনিক! তাই আপনি মজা না পাইলেও আপনার জাগরণের জন্যে মুভিটা দেখবেন। না দেখলে চটজলদি দেইখা ফালান। রিভিও শেষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *