বছর শেষে জীবনের বেহিসাবি হিসাবঃ কী হারাইলেন?

২০১৬। বছরটা শেষ হইয়া আসলো। সামনে আসবে নয়া বছর। নয়া ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডারের কথা মনে আসলে আমার ছোটবেলার কথা মনে পইড়া যায়। কাগজের ক্যালেন্ডার দেইখা তারিখ বইলা দেওয়াটা ছোটবেলায় আমার কাছে বেশ আশ্চর্যজনক বিষয় বইলা ঠেকত।

ক্লাস টু অথবা থ্রিতে যখন পড়তাম, তখন বড় ভাইয়ের বিদেশ থাইকা পাঠানো ক্যাসিও ডিজিটাল ঘড়ি দেইখা সময়, মাস এবং তারিখ দিব্যি বইলা দিতে পারতাম। কিন্তু খটকাটা বাঁধত কাঁটাওয়ালা ঘড়ি দেইখা টাইম বলা আর ক্যালেন্ডার দেইখা তারিখ বলা নিয়া। এইখানে অনেক কিছু হিসাব কইরা তারপর বলতে হয়।

একটা ক্যালেন্ডার দেখাইয়া যখন বড় আপুরে বলতাম, “আপু বল তো আজকে কত তারিখ?”। আপু কিছুক্ষণ ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাইয়া যখন তারিখটা বলত, আমি হাতের ক্যাসিও ঘড়িটার স্ক্রিনে ভাইসা উঠা তারিখের সাথে মিলাইয়া আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাস করতাম, “আপু, ক্যালেন্ডারে তো অনেক গুলা মাস আর তারিখ একসাথে দেওয়া। তুমি ক্যামনে বুঝলা কোনটা আজকের তারিখ?” আপু তখন হিসাবটা বুঝাইত আমারে। কিন্তু আমার মাথায় হিসাবটা ঠিক বসত না। তাছাড়া ঘড়ি দেইখা যখন তারিখ বলা যায় তখন কষ্ট কইরা হিসাব কইরা এইটা ক্যালেন্ডার থাইকা বাইর করার কি দরকার!

শৈশবে এমন আরও অনেক কিছুরই হিসাব মাথায় ঢুকতে চাইত না। এইটা সবার বেলাতেই হইয়া থাকে। শিশুদের এই হিসাব নিকাশ বোঝার অক্ষমতা আর এইটা না বোঝার কারণে তাঁদের বেশীরভাগ অযৌক্তিক আবদাররে আমরা বইলা থাকি “চাইল্ডিশ” আচরণ। এই আচরণ বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে। মগজটা যখন এডাল্ট হইয়া উঠে তখন সে অনেক হিসাব নিকাশ কইরা নিতে পারে। ইনফ্যাক্ট হিসাব করতে করতেই তাঁর জীবনটা পার হইয়া যায়।

বড় হওয়ার পরেও কেউ যখন বেহিসাবি কোন কিছু আবদার কইরা বসে, তখন তাঁরে আমরা চাইল্ডিশই বলি। কিন্তু একই সময়ে প্রায় সব শ্রেণীর মানুষই আবার তাঁর শৈশবটারে মিস কইরা থাকে। শিশুকালের কথা মনে কইরা সবাই আফসোস করে। আহারে যদি শৈশবটা আবার ফিরা পাইতাম! আবার কেউই চায় না কোন প্রাপ্ত বয়স্ক লোক শিশুদের মত আচরণ করুক। এখন প্রশ্ন হইলো, শিশুকালের কোন জিনিসটারে আসলে আমরা মিস করি? সেইটা হইলো, শৈশবের ইনোসেন্স (Innocence) আর চার্ম (Charm)। বড় হইতে হইতে এইটা আমরা হারাইয়া ফেলি। আমরা বড় হই, হিসাবি হই, চালাক হই, সফল হই, কিন্তু সেইখানে কোন চার্ম থাকে না। তাই বড় হইয়া শৈশব নিয়া আফসোস করা ছাড়া আর কোন উপায়ও থাকে না।

একজন এডাল্ট মানুষ যখন শৈশবের ইনোসেন্স আর চার্ম ধইরা রাখতে পারে, তখন তাঁরে বলা যায়, “চাইল্ডলাইক”। তবে একজন চাইল্ডলাইক হইতে হইলে আগে চাইল্ডিশ আচরণ আর চিন্তা ভাবনাগুলারে ছাড়তে হয়। নয়তো জীবনের কাছে ঠিক মত একসেস পাওয়া যায় না। কিন্তু এইখানে মজার বিষয় হইলো, সবাই বড় হইতে হইতে, চালাক হইতে হইতে, সফল হইতে হইতে যেইসব হিসাব নিকাশের মধ্য দিয়া যায় এইগুলা সবই হইলো একটা এডাল্ট ব্রেইনের প্রাইমারি ফাংশন। এই প্রাইমারি লেভেলের পরে আর কেউ আগাইতে চায় না কিংবা আগাইতে পারে না। এর ফলে সবাই আপাতদৃষ্টিতে এডাল্ট হইয়া উঠলেও, সে আসলে চাইল্ডিশই থাইকা যায়। কারণ সে সাধারণত সার্ফেস লেভেলের ইঁদুর দৌড়ের হিসাব নিকাশ ছাড়া জীবনের আর কোন হিসাব ঠিক বুইঝা উঠতে পারে না। তখন সে তাঁর জীবনের গভীর হিসাবটা ছাইড়া দেয় সমাজের হাতে, কালচারের হাতে, অনুসারিত কাল্টের হাতে, আর আদর্শের হাতে। সমাজরে, কালচাররে, কাল্টরে মানুষ ‘ফাদার ফিগার’ মনে করে। সে মনে করে বাবা ছেলেরে যেমনে দিক নির্দেশনা দেয়, এইগুলাও তাঁরে সেইরকম দিক নির্দেশনা দিব। দেয় ঠিকই, কিন্তু এইগুলা তাঁরে জীবনের কাছে নিয়া যাইতে পারে না। উল্টা আরও দূরে সরাইয়া নেয়। মানুষের মধ্যে ভয় আর লোভ ইনপুট কইরা তাঁদেরকে লাইফলেস হিংস্র প্রাণী বানাইয়া ফেলে। এতে কইরা মানুষগুলা হইয়া উঠে একেকটা প্রিজনার। কারণ প্রিজনার না হইলে আবার এদেরকে নিয়ন্ত্রন করা যায় না, এরা নিজেরাই নিজেদেরকে ভয় পায়। এবং এইটা একটা Vicious Circle (দুষ্ট চক্র)। প্রথমে সমাজ একটা শিশুরে চিন্তার দিক দিয়া লুলা বানাইয়া দেয়, পরে এই শিশু বড় হইয়া আর উপায় না পাইয়া নিজেই প্রথার কাছে নিজেরে সইপা দেয়।

এইরকম ভাবে মানুষ যখন চাইল্ডিশই থাইকা যায়, তখন আর সে ইঁদুর দৌড়ে হাঁপাইয়া জীবন পার করা ছাড়া জীবনের কোন স্বাদ নিতে পারে না। এদের মধ্যে কেউ যখন এই দুষ্ট চক্রটা ভাইঙ্গা বাইর হইয়া আইসা কথা বলা শুরু করে। তখন তাঁর সব কথাবার্তারে সবাই অতি উচ্চ লেভেলের অসম্ভব আলাপ কিংবা ব্লাসফেমাস আলাপ মনে করে। তাঁদের এই মনে করাকরির কারণে তাঁদের নাকের সামনে সত্যটা আইনা তুইলা ধরলেও তাঁরা ধরতে পারে না। এই না পারার কারণ হইলো, মানুষগুলা জীবনরে নির্দিষ্ট কয়েকটা পরিচিত ডাইমেনশনের বাইরে গিয়া চিনতে পারে না। তাঁদেরকে যতই বুঝানো হয়, তাঁরা কিছুই বুঝব না যতক্ষণ যা বুঝাইবেন তা একটা ডাইমেনশনে গিয়া না পড়ব। তাঁরা সবকিছু বোঝার জন্যে একটা নির্দিষ্ট জায়গা চায় যেইখানে দাঁড়াইয়া বুঝতে পারবে জিনিসটা আসলে কি। কিন্তু মজার ব্যাপার হইলো, জীবন আসলে ‘নো ডাইমেনশনাল’। সব ডাইমেনশন ক্রস কইরা যখন আপনে কোথাও আর দাঁড়ানোর জায়গা পাবেন না, খালি ভাসবেন, তখনই জীবনের সাথে আপনার দেখা হইব। আর সেইটা করতে আপনারে ব্রেইনের প্রাইমারি ফাংশন পার হইয়া, সেকেন্ডারি, টারশিয়ারি লেভেলের পরে গিয়া আল্টিমেট আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর লেভেলে পৌঁছাইতে হইব।

এখন এই আল্টিমেট আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর লেভেলে পৌঁছাইতে আপনারে এডাল্ট হইতে হবে। হইতে হবে ‘চাইল্ডলাইক এডাল্ট’, নট ‘চাইল্ডিশ এডাল্ট’।

হ্যাঁ, আমি শুরুতে নয়া বছর আর নয়া ক্যালেন্ডারের কথা বলতেছিলাম। কিন্তু ক্যালেন্ডারের কথা আমারে আল্টিমেট আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর দিকে টাইনা নিয়া আসল। আমি আসলে ক্যালেন্ডারের কথা বলতে বসি নাই, কিংবা পুরান বছরের হিসাবের কথাও না, কিংবা নয়া বছর আসলে কি করা যায় সেইটার কথাও না। কারণ, এইসব নয়া বছর, আর পুরান বছর, আর ক্যালেন্ডার – কোন কিছুর সাথেই জীবনের জোরাল কোন সম্পর্ক নাই। তবে আমাদের তৈরি নিয়ম কানুনের দুনিয়ায় সময়ের একটা হিসাব রাখতে হয়। নইলে আমরা আবার দিশাহারা হইয়া যাই। দিশাহারা হওয়াটা আবার খুব ভয়ঙ্কর একটা বিষয় কিনা! সবাই তো শুধু দিশা খুঁইজা বেড়ায়। তাই আমরা নিজেদের দিশা ঠিক রাখার লাইগা সময়রে দিন, মাস, বছর, মিনিট, ঘণ্টা, সেকেন্ড ইত্যাদি বিভিন্ন ভাগে ভাগ করছি। এবং সেই ভাগ দিয়া হিসাব কইরা আমরা বাইচা থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের এই ভাগাভাগিতে সময়ের কিছুই আসে যায় না। সময় থাকে এইসব ভাগাভাগির বাইরে। ঠিক তেমনই জীবনও থাকে আমাদের নিজদের ফিক্সড কইরা দেওয়া সব ডাইমেনশনের বাইরে।

সময়ের এই ভাগাভাগিরে যখন আপনে সিরিয়াসলি নিবেন না, তখন দেখবেন, সময় বইলাও কিছু নাই। আছে অন্তহীনতা। বছরের শুরু আর শেষও আপনে খুইজা পাইবেন না। কিন্তু এই যে আমাদের ভাগাভাগির এত আয়োজন সেইটারে কি আপনারে ইগনোর বলতেছি? উত্তর হইল, না। আমি খালি আপনারে এই সব ভাগাভাগির বাইরে গিয়া নিজের চোখ দুইটা পাতার আহবান করতেছি। এই চক্ষু মেইলা তাকানোটাও যেহেতু আপনার কাছে একটা ব্লাসফেমাস ব্যপার বইলা মনে হইতে পারে, তাই এই চোখ খুলতে আপনার অনেক কষ্ট হইব সেইটা স্বাভাবিক। কিন্তু কি করবেন, না খুললে যে কিছুই দেখবেন না!

যাইহোক, নন-সিরিয়াস হইলেও যেহেতু একটা বছর আমাদের কাছ থাইকা চইলা যাইতাছে, তাই সবার মনেই হিসাব নিকাশের উদয় হইতেছে। আর এই হিসাবে সবারই কি পাওয়ার কথা ছিল আর কি পাইল, কি করার কথা ছিল আর কি করল এইটাই ঘুইরা ফিরা আসে। কিন্তু আমি আবার উল্টা হিসাবি। আপনার আসলে কিছুই পাওয়ার কথা ছিল না, কিছুই করার কথা ছিল না। শুধু জীবনরে যাপন করার জন্যে জীবনের কাছাকাছি থাকার কথা ছিল। আপনে, আমি, আমরা প্রতিদিন, প্রতি বছর শুধু জীবনের কাছ থাইকা দূরে সইরা যাই, অথবা আমাদেরকে সরাইয়া দেওয়া হয়। আমরা শুধু হারাই। হারাই আমাদের আমাদের ইনোসেন্স, হারাই আমাদের চার্ম। যেন সবাই বড় হওয়ার ছলে একটা হারানোর প্রতিযোগিতায় নামছি, বুড়া হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামছি।

এখন না চাইলেও নয়া বছর নামে একটা জিনিস দিন কয়েক দিন পরেই আইসা উদয় হইব আমাদের ক্যালেন্ডারে। নয়া ক্যালেন্ডারে বড় অক্ষরে লেখা থাকব ‘২০১৭’। যদি তখনও চক্ষু মেইলা না তাকান তাইলে আসছে বছরেও আপনার আর জীবনের মাঝখানে দুঃখজনক ভাবে পর্দা হইয়া থাকব এই নয়া ক্যালেন্ডার।

শরিফুল ইসলাম
ডিসেম্বর ২৪, ২০১৬।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *