মুভি দ্যা লবস্টার (২০১৫) — কাল্পনিক ডিস্টোপিয়ান সোসাইটির ছলে দেখানো আমাদের বাস্তব সমাজেরই প্রতিচ্ছবি

ধরেন আপনারে এমন একটা সোসাইটিতে নিয়া ছাইড়া দেওয়া হইল, যেইখানে আপনার স্ত্রী/স্বামী মইরা গেলে কিংবা আপনারে ছাইড়া চইলা গেলে সাথে সাথে আপনারে একটা হোটেলে এসকর্ট করা হবে। সেই হোটেলে আপনারে পয়তাল্লিশ দিন সময় দেয়া হবে। এই সময়ের মধ্যে আপনারে একটা লাইফ পার্টনার বাইছা নিতে হবে হোটেলের অন্যান্য বাসিন্দাদের মধ্য থাইকা। যদি আপনে পয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে কাউরে ম্যানেজ করতে না পারেন, তাইলে আপনার পরিণতি হবে ভয়ংকর। আপনারে হোটেল কর্তৃপক্ষ একটা ট্রান্সফরমেশন রুমে নিয়া মানুষ থাইকা পশু বানাইয়া দিবে। তবে আপনে কি ধরণের পশুতে রূপান্তরিত হইতে চান, শর্ত সাপেক্ষে সেই অপশনটা হয়তো আপনারে দেয়া হবে। পশু হইয়া যাওয়ার পর, আপনে যে ধরণের পশু হইলেন তাঁর আচরণগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আপনারে হয় জঙ্গলে ছাইড়া দেয়া হবে, না হয় চিড়িয়াখানায় বন্ধি কইরা রাখা হবে। পরিস্থিতি যখন এইরকম, তখন আপনার মনে হইতে পারে যে জীবন বাঁচানোর জন্যে যে কারো সাথে জুটি বাইধা নিলেই তো হইব। কিন্তু কাজটা এত সহজে করা যায় না। জুটি বাঁধার ক্ষেত্রে পার্টনারের সাথে আপনার মারাত্নক সিমিলারিটি থাকতে হইব। যেমন আপনে যদি কানা হন, তাইলে আপনার পার্টনাররেও কানা হইতে হবে, অথবা আপনার যদি নাক দিয়া রক্ত পড়ার সমস্যা থাকে, তাইলে আপনার পার্টনারেরও নাক দিয়া রক্ত পড়তে হইব। এইরকম ভাবে যদি আপনে আপনার সিমিলার কোন পার্টনার পাইয়াও যান, তারপরেও আপনাদেরকে নরমাল লাইফে ফিরা যাইতে আরও অনেক কাঠ খড় পোড়াইতে হইব। এইরকম একটা সোসাইটিরে বলা হয় ডিস্টোপিয়ান সোসাইটি। এখন আপনে ভাবতে পারেন এইরকম একটা সোসাইটিতে আপনারে ছাইড়া দেওয়ার যে কল্পনাটা আমি করতাছি, সেইটা পুরাই এবসার্ড। এইরকম আবার সোসাইটি হয় নাকি! কিন্তু মজার বিষয় হইল, আপনে বর্তমানে এইরকম একটা সোসাইটিতেই বসবাস করতেছেন। সেইটা ক্যামনে তা বোঝার জন্যে চলেন এখন আমরা মুভিতে ঢুইকা পড়ি।

মুভির নাম দ্যা লবস্টার। কিন্তু পুরা মুভিতে একবারের জন্যেও আপনি কোন লবস্টারের দেখা পাইবেন না, শুধু একবার লবস্টারের কথা শুনতে পাইবেন। উপরে যেই ডিস্টোপিয়ান সোসাইটির বর্ণনা দিলাম এইরকম একটা সোসাইটির কাহিনী নিয়াই বানানো হইছে মুভিটা। শুরুতে দেখা যায় যে মুভির কেন্দ্রীয় পোলাডার বউ তাঁরে ছাইড়া চইলা গেছে। তারপর তাঁরে সমাজের আইন অনুযায়ী একটা হোটেলে এসকর্ট করা হইছে। তাঁর লগে থাকে একটা কুত্তা। কুত্তাটা আসলে তাঁর মায়ের পেটের আপন ভাই। একলা হইয়া যাওয়ার পরে পয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে কোন পার্টনার যোগাড় করতে না পারায় তাঁর ভাইটারে কুত্তা বানাইয়া দেওয়া হইছে। সেই হোটেলে অদ্ভুত সব নিয়ম আর রিচুয়াল বিদ্যমান। নতুন কোন মেম্বার আসলে প্রথম দিকে তাঁর কোমরের সাথে একহাত হাতকড়া দিয়া আটকাইয়া দেওয়া হয়, বাকী হাত দিয়া তাঁর সব কাজকর্ম করা লাগে। এই হোটেলে কেউ মাস্টারবেসন করতে পারে না, কইরা ধরা পড়লে তাঁর হাতে ইলেকট্রিক হিট দিয়া কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়। কিন্তু মজার বিষয় হইল, মাস্টারবেসন করতে না দিলেও, হোটেলের মেইড আইসা সবাইরে সেক্সুয়াল স্টিমুল্যাশন কইরা দিয়া যায়। এবং এইটা বাধ্যতামূলক। প্রতিদিন হোটেলের মেম্বারদেরকে সাথে ট্র্যাঙ্কুলাইজারের অস্ত্র দিয়া জঙ্গলে শিকারে পাঠানো হয়। তবে সেইখানে গিয়া কেউ পশু শিকার করে না। তাঁরা সবাই জঙ্গলের ভিতর নিজেরাই একে অন্যরে শিকার করে। ট্র্যাঙ্কুলাইজার দিয়া কেউ যদি একজনরে মারতে পারে তাইলে তাঁর হোটেলের পয়তাল্লিশ দিনের সাথে আরও একদিন আয়ু যোগ হয়। যে যত বেশী মারতে পারে তাঁর আয়ু তত বাড়তে থাকে। এমন সব অদ্ভুত রীতি নীতি আর অদ্ভুত সব চরিত্রের সাথে আমাদের কেন্দ্রীয় পোলাডার ডিল করা নিয়া আগাইতে থাকে মুভির কাহিনী।

মুভিটারে বলা হয় সারিয়াল কমেডি। এইটাতে আছে ডার্ক হিউমার এবং সোশ্যাল স্যাটায়ার। মুভির কাহিনীর সাথে আপনে বাস্তব সমাজের মিল পুরাপুরি খুইজা হয়তো পাইবেন না। এমনকি আপনার মনে হইতে পারে যে এই মুভির সাথে বাস্তবতার কোন মিলই নাই। আপনার এই মনে হওয়ার প্রথম কারণ, মুভিটা হইল সমাজের মকিং মিরর। সমাজের মধ্যে বিদ্যমান ফলি গুলা মানুষরে চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখানোর জন্যে মুভি অথবা উপন্যাসে সেইটা মক কইরা দেখানো হয়। এতে কইরা জিনিসগুলা স্পষ্ট হইয়া চোখে ভাসে। মিল না পাওয়ার দ্বিতীয় কারণ, মুভিটার গভীরে ঢুকতে না পারা। এইবার আসেন মুভির সাথে আমাদের সমাজের মিলগুলা কোন জায়গায় সেই দিকে একটু টর্চ ফালাই।

প্রথমত মুভিটার মত আমাদের সমাজও মানুষের একা থাকটারে ভালো চোখে দেখে না। আমাদের সমাজে কেউ একা থাকলে তাঁরে জোর কইরা পশু বানাইয়া না দিলেও, পরিবেশটা এমন কইরা রাখা হইছে যেইখানে চাইলেও কেউ আরাম কইরা একলা থাকতে পারবে না। কোন মানুষ একা থাকলে সমাজপতিদের জন্যে সে একটা হুমকি হইয়া দাঁড়ায়। কারণ তাঁর মত অনেকেই যদি সমাজে একা থাকে তাইলে তাঁদেরকে শাসন করতে গিয়া সমাজ বিপাকে পইড়া যায়। সমাজ আমাদেরকে শাসন করার জন্যে অনেকগুলা নর্মস এবং রেগুলেশন তৈরি কইরা রাখছে। এবং আমরাও মেরুদণ্ডহীনের মত অর্থাৎ এই মুভির চরিত্রগুলার মত সমাজের সেই রুলসের সাথে নিজেরে ফিট করাইয়া নিতে চাই। এতে কইরা আমাদেরকে আমাদের ব্যক্তিগত অনুভুতি এবং ইন্সটিংকট গুলারে সাপ্রেস করতে হয়। এবং আমরা এইটা প্রতিনিয়ত কইরা যাই। মুভির মত আমরাও লাইফ পার্টনার খুজতে গিয়া তাঁর মধ্যে সিমিলারিটি খুইজা বেড়াই। আমরা ভুইলা যাই যে, মহাবিশ্বে সবাই এবং সবকিছুই একটা একক এনার্জির এক্সপ্রেশন হইলেও, প্রতিটা মানুষ ইনডিভিজুয়ালি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়া জন্মায়। মুভিতে দেখা যায়, প্রতিটা চরিত্র হাইপার-পলাইট-ম্যানারে কথা বলে, এবং সবার গলার টোনই প্রায় এক। একই রকম ভাবে, আমাদের সমাজেও এলিটদের দেওয়া কিছু ভাষাগত এবং আচরণগত ষ্ট্যাণ্ডার্ড আছে। এবং মধ্যবিত্ত মেজরিটি এলিটদের দেওয়া এই ষ্ট্যাণ্ডার্ডরে কপি করার চেষ্টা প্রতিনিয়ত কইরা যায়। যেমন আমার এই রিভিওর ভাষাগত স্টাইলটা আপনার পড়তে ভালো লাগব না এই সম্ভাবনাই বেশী। কারণ আমার এই ভাষাটা এলিটদের দেওয়া ষ্ট্যাণ্ডার্ডরে ফলো করে না। মুভিতে বুঝাইয়া দেওয়া হয় যে, আমরা মানুষরা কেবল সমাজের দেওয়া কিছু রুলস আর ম্যানারের সমষ্টি না। আমরা আরও বেশী কিছু। এবং দুঃখজনকভাবে সত্য হইল, আমরা নিজেদেরকে এই রুলস আর ম্যানেরের মধ্যেই হারাইয়া ফেলছি, কিংবা দিনে দিনে হারাইয়া ফেলতাছি।

মুভির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করছে আইরিশ অভিনেতা কলিন ফেরাল। মুভিটারে রোম্যান্টিক কমেডিও বলা যায়। কারণ, অদ্ভুতভাবে হইলেও মুভিতে নায়ক আর নায়িকার মধ্যে একটা প্রেম দেখানো হইছে। মুভিটার ভয়েস ওভার ন্যারেটিভ স্টাইলটা একটু আলাদা। নায়িকা শুরু থাইকা মুভিটা থার্ড পারসন ন্যারেটিভে বর্ণনা করলেও, নায়িকার সাথে আমাদের দেখা হয় মুভির প্রায় মাঝামাঝি গিয়া। এবং শেষের দিকে ন্যারেটিভটা থার্ড পারসন থাইকা সেকেন্ড পারসনে টার্ন নেয়। মুভিটা বানানো হইছে পাঁচটা দেশের যৌথ প্রযোজনায়। রটেন টমেটোতে মুভিটা ৯০% ফ্রেশ।

রিভিও শেষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *