420493975 7478333218846356 8228628260430113863 n

কিলার স্যুপ

জগতের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে চাইনিজ মিথোলজিতে বলা হয়, জগত এক বস্তুগত শক্তির প্রাথমিক ক্যাওস থেকে সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে সৃষ্টি পরবর্তী জগত নিজেই নিজেকে একটা সাইকেলের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে ফেলেছে। এক্ষেত্রে জগতের সকল শক্তি মূলত দুইটা রূপ ধারণ করে আছেঃ বস্তু আর প্রাণ। চাইনিজ দর্শনে জগত শৃঙ্খলের সাইকেলটাকে বলা হয়, ইন এবং ইয়াং। ইন এবং ইয়াং হল একটা ডুয়ালিটি—ভালো–মন্দ, আলো-অন্ধকার, দিন–রাত, গরম-ঠাণ্ডা। বলা হয়, জগতে সকল কিছুতেই এই দুইটা বিপরীত শক্তির উপস্থিতি থাকে। একটাকে ছাড়া আরেকটার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। আলো ছাড়া কোন ছায়া হয় না। মন্দ ছাড়া কি ভালোকে ‘ভালো’ বলা যায়? যায় না।

জগত কীভাবে সৃষ্টি হল সেই ঘটনা অথবা তত্ত্ব আমাদের অবজার্ভেবল রিয়্যালিটির মধ্যে না পড়লেও, আমাদের অভিজ্ঞতার দৈনন্দিন রিয়্যালিটি এবং পদার্থ বিজ্ঞানে আমরা ‘ইন এবং ইয়াং’-এর অস্তিত্ব দেখতে পাই। অর্থাৎ, পজিটিভ–নেগেটিভ, এমাথা–ওমাথা, সুখ-দুঃখের মত বাইনারি অপোজিশনের মধ্য দিয়ে বস্তু আর প্রাণিজগতের রিয়্যালিটি মুভ করে। এটা রিয়্যালিটির একটা ব্যাসিক প্যাটার্ন। এই প্যাটার্ন আমাদেরকে বৈদ্যুতিক এনার্জি ব্যবহার করতে সহায়তা করে, আমাদেরকে মন্দ থেকে ভালোকে আলাদা করতে সহায়তা করে, আমাদেরকে রাত থেকে দিনকে আলাদা করে চিনতে সাহায্য করে এবং সর্বোপরি ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল—এটা আমাদেরকে রিয়্যালিটির ক্যাওস থেকে জগতের তথা মানব জীবনের একটা অর্থ দাঁড় করাতে সাহায্য করে—আর এটাই মানবের সাথে করা রিয়্যালিটির কিংবা মানব মনের নিজেরই তৈরি করা সবচাইতে বড় প্রতারণা কিংবা ভ্রম।

রিয়্যালিটিতে এমন একটা ব্যাসিক প্যাটার্ন থাকা সত্ত্বেও রিয়্যালিটি মূলত ক্যাওস তথা বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ। এখানে মন্দ মানবেরা সবসময় শাস্তি পায় না, আবার পেতেও পারে; এখানে সুন্দর সবসময় স্থায়ী হয় না, আবার অনেকদিন হতেও পারে; এখানে ভালো হৃদয়ের অধিকারী মানুষেরা সবসময় সুখী হয় না, আবার কেউ কেউ হতেও পারে; এখানে প্রেমের বিপরীতে প্রেম মেলে, আবার মেলে ঘৃণাও; এখানে নিষ্পাপ শিশুর কপালে জুটতে পারে করুণ মৃত্যু, আবার সুন্দর শৈশব পেরিয়ে কারও যৌবন আহরণ করতে পারে স্বর্গসুখ। ক্যাওস। এ-তো গেল মানবকেন্দ্রিক ক্যাওস। ব্রহ্মাণ্ডের ফিজিক্যাল মুভমেন্টেও কোন শ্বাশ্বত প্যাটার্ন দেখতে পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় না কোন আল্টিমেট ডেস্টিনেশনও। এহেন ক্যাওসে—মানব মনের স্যানিটি হারিয়ে যায়। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ে চির-কাঙাল-মনুষ্যমন।

তবে মানবের মন বড় ক্রিয়েটিভ। সে তার নিজের অটো ইমিউনের মাধ্যমেই বের করে ফেলে নিজের স্যানিটি ধরে রাখার হাজারও পন্থা। আর্ট, আধ্যাত্মিকতা, কর্ম, ধর্ম। মানুষ রিয়্যালিটির এই উদাসীন অবিচার আর র‍্যান্ডমনেসকে ঠেস দেয় কর্মফলের তত্ত্ব দিয়ে। সে নিজের গোত্রের মন্দ লোকটাকে নিয়ে বিচার বসায়, পুরস্কিত করতে চায় পুন্যতাকে। সে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় রিয়্যালিটির এনট্রপিকে। এতে কি কাজ হয়? হয়, অনেকটাই হয়। অন্তত, মেজরিটি মানব মনের দুর্বল স্যানিটিকে অক্ষত রাখার ক্ষেত্রে কাজ হয়। এক্ষেত্রে ধন্যবাদ জানাতে হয় রিয়্যালিটির এপারেন্ট প্যাটার্নগুলোকে, ধন্যবাদ জানাতে হয় মানব মস্তিষ্কের ভ্রম উৎপাদনকারী ক্ষমতাকেও। এগুলোই আমাদের বেঁচে থাকার মূল শক্তি।

কিন্তু শাকে ঢাকা মাছ—এনট্রপির তীব্রতায়—প্রকাশিত হয়ে পড়ে কোন কোন মানবের চোখে। ভারতীয় পরিচালক অভিষেক চৌবে’র ক্যামেরার চোখেও প্রকাশিত হয়েছে শাকের তলের সেই মাছগুলো। তার ডার্ক কমেডি “কিলার স্যুপ (২০২৪)”-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র সাথী শেটি আর উমেশ পিল্লাই-এর “মন্দ” মন আর রিয়্যালিটির র‍্যানডমনেসে মারা পড়া কয়েকটি “ভালো” মানুষের মৃত্যুর যোগসংযোগে ফুটে উঠেছে মানব কেন্দ্রিক ক্যাওসের চেহারা।

শাকের তলে মানবের জীবন এমনই ক্যাওটিক, অনিয়ন্ত্রিত এবং অনায্য। এখানে দৈবাৎ হল সবচাইতে বড় শাসক, যার কোন বাপ নেই, মা নেই, নেই কোন মরাল গ্রাউন্ড। ব্রিটিশ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত চরিত্র ম্যাকবেথ যখন শুনতে পেয়েছিলেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী লেডি ম্যাকবেথের মৃত্যুর খবর, তখন যন্ত্রণায়—অ্যাবসার্ডিটিতে—তিনি বলে উঠেছিলেন, লাইফ ইজ অ্যা টেইল টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট, ফুল অব সাউন্ড এন্ড ফিউরি, সিগনিফাইয়িং নাথিং। নাথিং এট অল।

Comments

comments

123 views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *