রিয়্যালিটি কোনদিকে বহে?

অতীতে মানুষ কেমন ছিল? তুলনামূলক সুখী? নাকি দুঃখী? অতীত বলতে কত দূরের অতীত? দশ বছর আগের? নাকি দশ হাজার বছর আগের? অতীতকে নিয়ে ব্রিটিশ উপন্যাসিক এল. পি. হার্টলি বলেছিলেন, অতীত একটা ভিনদেশঃ ঐ দেশের মানুষদের কাজকর্ম ছিল ভিন্ন। অর্থাৎ, আমরা এখন যা যেভাবে করি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা কিংবা নারীরা তা সেভাবে করতো না। হার্টলির এই কথার রেশ ধরে অ্যামেরিকান সাইকোলজিস্ট স্টিভেন পিঙ্কার মানুষের অতীতের ইতিহাসকে তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, অতীত যদি একটা ভিনদেশ হয়ে থাকে, তবে সেই দেশটা ছিল প্রচণ্ড হিংস্রতায় ভরা। এই অতীত বলতে পিঙ্কার দশ হাজার বছর কিংবা তারও আগের অতীতকেই বুঝিয়েছেন।

বর্তমানের সাথে আপাত তুলনায় অতীতের মানুষ বড্ড হিংস্র ছিল। তখন কথায় কথায় একজন আরেকজনকে খুন করতো। ভায়োলেন্স ছিল মানুষের নিত্যদিনের চর্চা। বর্তমানে সাইন্টিফিক উপায়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের করা বিভিন্ন স্টাডি থেকে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায় আমাদের পূর্বপুরুষরা কী পরিমাণ হিংস্রতায় ডুবে থাকতেন। পিঙ্কারের মতে, মানুষের এই হিংস্রতা দিনে দিনে কমে এসেছে। বর্তমানে আমরা আগের তুলনায় বেশ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বাস করছি। এর পেছনে কাজ করেছে বেটার সারভাইভালের লক্ষ্যে মানুষের সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ। কাজ করেছে মানুষের এমপ্যাথি।

উল্টোদিকে, আমাদের দেশীয় বাউল আব্দুল করিম তার এক গানে দুঃখের সুরে বলেছেন, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা…। তার এই গানের প্রতিটা লাইনে ফুটে উঠেছে অতীতের প্রশংসা আর একটা আক্ষেপ, যে, অতীতের সেই সুন্দর পরিবেশ তথা আনন্দ এখন আর নেই। তবে, এখানে করিমের গানের অতীত আসলে খুব বেশিদিন আগের অতীত নয়। এটা সেদিনের সেই জারি গান / সারি গান আর যাত্রাপালার দিনগুলির অতীত।

অতীত নিয়ে করা পিঙ্কার এবং করিম, এর মধ্যে কার মন্তব্য সঠিক? দুজনেরই। পিঙ্কারের উপস্থাপিত তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের পূর্বপুরুষরা মারাত্মক হিংস্র ছিলেন, যেটা এখনকার মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্যহারে কমে এসেছে। আবার আব্দুল করিমের কথাও ঠিক, আমাদের আগের দিনগুলোই অনেক সুন্দর ছিল, দিনদিন সবকিছু কেমন কঠিন হয়ে যাচ্ছে, রংহীন হয়ে যাচ্ছে। এই কথা তো আমরা সকলেই প্রায় কোন না কোন সময় বলে থাকি, নস্টালজিয়া থেকে হলেও বলি। তাহলে আমরা কোনটা ধরে এগোবো?

পিঙ্কার মনে করেন, যেহেতু আমরা দিনে দিনে আমাদের কনশাস চিন্তা আর চেষ্টা দিয়ে হিংস্রতাকে কমিয়ে আনতে পেরেছি, তার মানে ভবিষ্যতেও আমরা আরও নন-ভায়লেন্সের দিকে এগোতে পারবো। এটা একটা আশাবাদ। অন্যদিকে, করিম মনে করেন (অন্তত এই গানে), দিনে দিনে আমরা আমাদের সুন্দর ঐতিহ্যসমূহ ভুলে গিয়ে অসুন্দরের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এটাও একটা আশাবাদ, এখানে মনে করা হচ্ছে, আমরা যদি আমাদের শিকড়, ঐতিহ্য সম্পর্কে আবার সচেতন হয়ে উঠতে পারি, তাহলে আমাদের দিবসগুলোর সৌন্দর্য পুনরায় ফিরে আসবে।

এই দুই ধরণের আশাবাদের উৎপত্তিস্থল কোনটা? সেটা হল, মানুষের সেন্স পারসেপশন। মানুষ রিয়্যালিটিকে একটা স্টার্ট পয়েন্ট এবং এন্ড পয়েন্টের মাঝামাঝি কিছু একটা মনে করে এক্সপেরিয়েন্স করে। অর্থাৎ, যেকোন গল্পের যেমন একটা শুরু থাকে এবং শেষ থাকে, সেরকম মহাকালে রিয়্যালিটির সকলকিছুকে মানুষ পেছন থেকে সামনের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে বলে ধরে নেয়। আর এই ফরম্যাটে তখন অতীত আর বর্তমানকে তুলনা করার সুযোগ থাকে।

কিন্তু রিয়্যালিটিতে তথা ব্রহ্মাণ্ডে তথা আমাদের চোখের সামনেই সবকিছু চক্রাকারে চলে। প্রাণীদের জীবনচক্র, চন্দ্র-সূর্যের প্রদক্ষিণ চক্র, ধ্বংস-সৃষ্টির চক্র।

মনুষ্যজীবনের সকল কর্মকাণ্ডও এই চক্রের তালে চলে। প্রতিদিন একই সূর্য দেখে ঘুম থেকে উঠা, একই কাজ, একই আবেগ, একই দুঃখ, একই সুখ, একই স্বাদ, একই বিষাদ, একই উত্থান আর একই পতনের এক চক্রের মধ্য দিয়েই যাপিত হয় একটা মনুষ্যজীবন।

তাহলে চক্রাকার এই রিয়্যালিটির মধ্যে মানুষ কেন অতীত থেকে–বর্তমান হয়ে–ভবিষ্যতের দিকে প্রবাহমান একটা ওয়ান ডিরেকশনাল রিয়্যালিটির কথা মাথায় রেখেই এত আশাবাদ পুষে রাখে আর এটা দ্বারাই তাড়িত হয়? কারণ, মানুষের মস্তিষ্ক এভাবেই প্রোগরামড্‌। এটাই মনুষ্য সভ্যতার টিকে থাকার রশদ। মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত রিয়্যালিটির ‘কারেন্ট স্টেট’ আর ‘ডিজায়ারড্‌ স্টেট’এর মধ্যকার গ্যাপ মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। আর এই কাজই মানুষের গতি।

তবে এই গতিটা এপারেন্ট। আসলে হয়তো কিছুই এগোচ্ছে না। স্টোয়িক দার্শনিক মার্কাস অরেলিয়াস বলেন, আপনি কোথায় জন্মালেন, শহরে নাকি গ্রামে, আজকে, নাকি এক মিলিয়ন বছর আগে সেটা কোন ব্যাপার নয়। আপনি কতদিন বাঁচলেন, ষাট বছর, নাকি ষাট হাজার বছর সেটাও কোন ব্যাপার নয়। হিউম্যান সাইকোলজির ব্যাসিক প্যাটার্ন আর বস্তুর অণু-পরমাণুর ব্যাসিক প্যাটার্ন অনন্তকাল একই থাকবে। শুধু প্রকৃতির ইনডিফারেন্ট রিসাইকেলিং প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে গিয়ে বারবার আমাদের মনে হবে এই বুঝি আমরা এগোলাম, পেছালাম, আবার এগোলাম…।

Comments

comments

260 views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *