টাবুলা রাসা

জগতে মানবের মধ্যে যে অসমতা দেখা যায় তা যন্ত্রণাদায়ক। মানুষের মধ্যে কেউ ধনী, কেউ গরীব, কেউ সুশ্রী, কেউ কুৎসিত, কারও বিপুল প্রতিভা, কেউ গণ্ডমূর্খ, কারও দেহবল অসুরের মত, কারও দেহ ভেঙে পড়ে ক্ষণে ক্ষণে, কেউ কথা দিয়ে যাদুকরের মত মাতিয়ে রাখতে পারে সবাইকে, কারও আবার দুচারটা কথা বলতেই পা কাঁপে, হাত কাঁপে। প্রাকৃতিক কিংবা ঐশ্বরিক নীতি হিসেবে মানবপ্রজাতির বেশিরভাগই এই বৈষম্য মেনে নিলেও যখন মানুষ একটু জটিল করে চিন্তা করতে শিখলো, তখন চিন্তাশীলদের কাছে ব্যাপারটা যন্ত্রণাদায়ক হিসেবে ধরা দিতে লাগলো। এই যন্ত্রণাকে লাঘব করার জন্য প্রাচীন গ্রীসে দার্শনিক এরিস্টটল ‘টাবুলা রাসা’র কথা বলেন। ‘টাবুলা রাসা’ কথাটি এসেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে, যার ইংরেজি অর্থ ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’। এরিস্টটলের মতে, একটা সদ্য জন্ম নেয়া মানবশিশুর মন হল শূন্য খাতার মত। জন্মের পর শিশুর চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন সবকিছুই গঠিত হয় তার শিক্ষা, চেষ্টা আর আশেপাশের পরিবেশের প্রভাব দ্বারা। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, জগতের সকল মানুষই সমান কোয়ালিটি নিয়ে জন্মায়। এরিস্টটলের পরে দার্শনিক ইবনে সিনা, ইবনে তোফাইল, একুইনাস ও রেনে দেকার্তরা এই ধারণাকে নিয়ে কথা বলতে থাকেন। সতেরো শতাব্দীতে এসে আধুনিক মানুষের কাছে এটাকে সবচাইতে বেশি জনপ্রিয় করে তুলেন দার্শনিক জন লক।

মানুষকে জন্মগতভাবে একটা ব্ল্যাঙ্ক স্লেট হিসেবে দেখাটা আধুনিক মানুষ হিসেবে আমাদের যন্ত্রণাটা অনেকটাই লাঘব করে। বলা যায় আধুনিক পৃথিবীর বর্তমান চেহারা নির্মাণে এই ধারণাটাই মূলে কাজ করেছে। রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে মানুষকে একটা সমতায় নিয়ে আসার চেষ্টায় এই চিন্তার বিকল্প নেই। এই চিন্তা দিনে দিনে মানুষের মধ্যে যত প্রকট আকার ধারণ করেছে, ততই নতুন নতুন সোশ্যাল মবিলিটি তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ অন্য শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে অ্যামেরিকায় মেরিটোক্রেসি চালু হয়েছে। লিঙ্গ বৈষম্য, বর্ণ বৈষম্যকে এখন কড়াকড়িভাবে এড্রেস করা হচ্ছে। যদিও এই চিন্তার ফলাফল হিসেবে জগতে কিছু  পরিবর্তন ছাড়া বৈষম্য তেমন একটা দূর হয়নি, কিন্তু একদিন তা দূর হবে এই আশায় মানুষ কাজ করে যাচ্ছে। যখন মানুষ এই মহৎ কাজটা করে যাচ্ছে, ঠিক তখন বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে নিউরোসাইন্স আবিস্কার করে ফেলেছে অন্য জিনিস। বিংশ শতাব্দীতে সুইস সাইকোলজিস্ট জাঁ পিয়াগেটের স্টাডি জেনেটিক এপিস্টেমোলজিতে দেখা যায়, কোন মানুষই আসলে ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে না। জিনগতভাবে একেকটা শিশু একেকরকমের প্রবণতা নিয়ে জন্মায়। জিনগত প্রবণতার পরে গিয়ে কাজ করে শিশুর পরিবেশ। অনেকের ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব দিয়ে জিনগত প্রবণতাকে চাপা দেয়া যায়, অনেকক্ষেত্রে যায় না।

তাহলে কি মানুষ সবাই সমান নয়? মানব সমাজ মানুষকে মূল্যায়ন করার জন্য যে বেঞ্চমার্ক তৈরি করেছে সেটাকে আমলে নিলে সব মানুষ কখনই সমান নয়। এটা কখনও হওয়াও হয়তো সম্ভব নয়। এখানে জিনের প্রভাব, পরিবেশের প্রভাব আর র‍্যান্ডমনেসের উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে একজন ব্যক্তির ভাগ্য। এখন কে ভাগ্যবান, কে দুর্ভাগা সেটার সামাজিক বেঞ্চমার্ককে তুলে পুরোটাকে দেখা যেতে পারে কেবল বৈচিত্র্য হিসেবে। যতদিন বিজ্ঞান আমাদের জিনকে এডিট করে আমাদের আকাঙ্ক্ষিত সমতার জীবন প্রদান করতে না পারবে, ততদিন আমাদেরকে আমাদের মনের নিউরোসিস, সাইকোসিস, ভাগ্যের নির্মমতাকে মোকাবিলা করার আগে বুঝতে হবে কতটুকু আমার জিনগত প্রবণতা থেকে নির্ধারিত হয়ে আছে, আর কতটুকু আছে আমার নিজের নিয়ন্ত্রণে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *