মানুষের স্যালভেশন কোথায়?

সভ্যতার উত্থানের মূলে কাজ করেছিলো মনুষ্যমনের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের খচখচানি। পাথরের টুল থেকে শুরু করে বর্তমানের সফিস্টিকেটেড টেকনোলোজি উদ্ভাবনের ধারায় প্যারালালি মানুষের দুটো খায়েস পূরণ হয়ে আসছেঃ একটা হল কৌতূহল নিবারণ, আরেকটা হল লাইফ কনভেনিয়েন্স। পাথরের টুলের পরে আগুন জ্বালানো, বিভিন্ন প্রাণীদেরকে গৃহপালিত করা, কৃষি কাজ এবং চাকা আবিস্কার এই সবই হিউম্যান কগনিশনের ডাইসেকশন (ব্যবচ্ছেদ)-এর ন্যাচারের ফল। এর সাথে ছিল জীবনকে কনভেনিয়েন্ট করার প্রবণতা। মানুষ যখন কোনকিছু উদ্ভাবন করে, তখন সে শূন্য থেকে কিছু সৃষ্টি করে না বা করতে পারে না। মানুষ কেবল প্রকৃতিতে থাকা রিসোর্সগুলোর অলটারেশন করতে পারে। অর্থাৎ মানুষ দ্বারা উদ্ভাবিত কোনকিছু প্রকৃতির বাইরের কিছু নয়। গুহা থেকে বের হয়ে এসে এখন মানুষ যে দালানে ঘুমায়, সেটা প্রকৃতি থেকে নেয়া মেটেরিয়াল দিয়েই তৈরি। কিন্তু অরণ্য আর নগরের মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য আমাদের চোখে ধরা পড়ে সেটাও উল্লেখযোগ্য। এই পার্থক্য থেকেই হোক অথবা ভাষাগত সীমাবদ্ধতা থেকেই হোক, মানুষ প্রকৃতি বলতে কেবল অরণ্যকেই বোঝে। মানুষ প্রকৃতিতে নিজেকে হারাতে চায়, যেন সে নিজে প্রকৃতির বাইরে থেকে আগত কোন সত্তা।

পোস্টমডার্ন জগতে মানুষ যখন নগরজীবনে হাঁপিয়ে উঠে, তখন সে নিজের স্যানিটিকে ফ্রেশ রাখতে, নিঃশ্বাস নিতে রিট্রিটে যায়। সেটা হয় অরণ্যে কিংবা সমুদ্রে। এক্ষেত্রে মনুষ্যমনে একটা সাধারণ ধারণা কাজ করে, সেটা হল, মানুষ যত বেশি প্রকৃতি—অর্থাৎ বৃক্ষ, জল, মাটি আর পাখপাখালির মধ্যে থাকবে, ততই তার ভেতরগত সরলতা, তারল্য, আর সজীবতা অটুট থাকবে। এই সূত্রে সাধারণত মানুষ মনে করে যে, যারা জীবনভর প্রকৃতিতে অথবা গ্রামাঞ্চলে বাস করে তাঁরা ভেতরগত দিক থেকে সরল হয়, প্রকৃতির ছোঁয়ায় কিংবা ছায়ায় তাদের মধ্যে হিংস্রতার জন্ম হয় না। কিন্তু বাস্তবচিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। বরং হিংসায়, হিংস্রতায় গ্রামের মানুষজন নগরের মানুষদের থেকেও বেশ এগিয়ে থাকে। সবুজ অরণ্যে মানুষের লাশ পাওয়া যায় অহরহ। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর ব্যাপার নিয়েও গ্রামের মানুষ খুন-খারাবিতে মেতে উঠতে পারে। এমনও দেখেছি, একজনের মুরগী আরেকজনের শুকাতে দেয়া দুচারটা ধান খেয়ে ফেলেছে এ নিয়ে তুমুল মারামারি। এছাড়া তাঁরা খুবই বদারসাম। সবাই সবার ব্যাপারে নাক গলায়। এর আবার ইতিবাচক দিকও রয়েছে। তাদের কম্যুনিটি ফিলিং হয় অনেক স্ট্রং এবং তাঁরা একে অন্যের সাহায্যেও এগিয়ে আসে সহজে। দুটোই কেন হয়? সাধারণত গ্রামাঞ্চলের মানুষের অবসর সময় থাকে অনেক বেশি।  একটা মনুষ্য মস্তিস্ক নগরের বাসিন্দা নাকি গ্রামের বাসিন্দা, অশিক্ষিত নাকি শিক্ষিত, তার ইভ্যুলুশনারি ইন্টেলিজেন্স সেটা কেয়ার করে না। তাকে কোন না কোন চিন্তা অথবা কর্মকাণ্ড দিয়ে সবসময় নিজেকে অকোপাই করে রাখতে হয়। তাই যেহেতু অবসর সময় বেশি, গ্রামের মানুষের মস্তিস্ক বদারসামও হয় বেশি, এক্ষেত্রে তার এনিম্যাল ইন্সটিংক্টগুলোও চাড়া দিয়ে উঠার স্পেস পায় বেশি।

অন্যদিকে, ক্যাপিটালিজমের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকা নগরবাসী জীবনভর থাকে দৌড়ের উপর। এখানে শুধু কাজ আর কাজ। এখানে স্পেস কম, আর বদারসাম হওয়ার সময়ও কম। এখানে হিংস্রতা কম, আবার সহমর্মিতাও কম। এখানেও মানুষ হিংস্র, কিন্তু সেটা চর্চা করার সুযোগ কম। শিক্ষার গুণে কিংবা কাজের চাপে কন্ট্রোল্ড বিহেভিয়ার আয়ত্ত্বকারী নগরবাসীর জীবন হয় অনেকটা ভোঁতা এবং ক্লান্তিকর।

মানুষের স্যালভেশন তাহলে কোথায়? আমরা তা সঠিক জানি না। কেবল এটুকু বোঝা যায়, মানুষ এমন এক প্রাণী যে, যেখানেই থাকুক না কেন সে এক চলমান অস্থিরতার মধ্যেই থাকবে। এটা তার ভেতরগত বৈশিষ্ট্য। বাহিরের কোন পারিপার্শ্বিকতা তার এই বৈশিষ্ট্যকে কেটে ফেলে দিতে তেমন একটা সাহায্য করতে পারে না। এক্ষেত্রে হয় তাকে জীবনভর কাজ নিয়ে দৌড়ের উপর থেকে তার ব্যালেন্স ধরে রাখতে হয়, না হয় নিজের ভেতরে তাকিয়ে নিজের ইন্সটিংক্ট, কমপালশন, মূর্খতা আর দুর্বলতাগুলোকে স্বীকার করে নিয়ে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে সেগুলোর সাথে একটা বোঝাপড়ায় গিয়ে টালমাটাল হয়ে হলেও একটা ব্যালেন্সে পৌঁছাতে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *