মানুষ কি পৃথিবীর ক্যান্সার?

নব্বই দশকের গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা ‘দ্যা ম্যাট্রিক্স’-এর এন্টি-হিরো এজেন্ট স্মিথ মানুষকে পৃথিবীর ক্যান্সার বলে অভিহিত করেছিল। তার ভাষায়, মানবজাতি হল একটা অসুখ, এই পৃথিবীর ক্যান্সার। তার এই কথাটা শুনতে খুবই বাজেভাবে নিহিলিস্টিক শোনায়। শোনার পর এটাও মনে হয় যে, যেহেতু সে এন্টি-হিরো, যেহেতু তার অবস্থান খারাপের পক্ষে, সেহেতু সে এমন কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা পরিবেশবাদী, যারা এই পৃথিবীকে সুন্দররূপে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তাদের মত করে পৃথিবীকে ভালোবাসলে এজেন্ট স্মিথ-এর সাথে আপনাকেও একমত হতে হবে। অর্থাৎ বলতে হবে মানবতা বিরোধী এজেন্ট স্মিথও একজন সত্যিকারের পরিবেশবাদী।

পরিবেশবাদীরা সাধারণত যেটা চায় সেটা হল পৃথিবীকে দূষণমুক্ত রাখা। কারণ, পৃথিবী দূষণমুক্ত থাকলে জীব বৈচিত্র্য টিকে থাকে, আর জীব বৈচিত্র্য টিকে থাকলে প্রাকৃতিক ব্যালেন্স ঠিক থাকে। এবং এই প্রকৃতির ব্যালেন্স নষ্ট করার ক্ষেত্রে যার অবদান অনেক বড় সেটা হল মনুষ্য প্রজাতি। আসলে, বড় নয়, মানুষই কেবল ব্যালেন্স নষ্ট করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে, অন্য কোন প্রাণী নয়। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, মনুষ্য প্রজাতি পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে গেলে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবে না, কেবল বর্তমানে যেসব প্রজাতি মানুষের উপর নির্ভর করে চলে, ইকোসিস্টেমে তাদের লাইফস্টাইলে একটা প্রভাব পড়বে, যা মানুষ ছাড়াও তাদের জন্য একপর্যায়ে এডাপ্ট করা সম্ভব। কিন্তু মানুষকে বাঁচতে হলে প্রকৃতির পুরো ইকোসিস্টেমের ব্যালেন্স অত্যন্ত জরুরী। মানুষ এতই ভঙ্গুর। আবার কেবল মনুষ্য প্রজাতিই পৃথিবীর প্রাকৃতিক ব্যালেন্সের ক্ষতি সাধন করার মত শক্তিশালী। পরিবেশবাদীরা চান, মানুষ যেন সচেতন হয়ে পরিবেশের ক্ষতি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। কিন্তু সচেতনভাবে মানুষ যতই পরিবেশের ক্ষতি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে না কেন, যে-কোন একটা মানব সন্তান জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রকৃতি থেকে যেটুকু ভোগ করবে তাতে পরিবেশের একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় ক্ষতিসাধন হবেই। মানবের ইগো ভিত্তিক এনার্জিটাই বিধ্বংসী। খেয়াল করলে দেখবেন, মানুষ নিয়মিত যে পথে হাঁটে সেখানে ঘাসও গজাতে চায় না।

পরিবেশবাদীরা প্রকৃতি-প্রেম থেকে পৃথিবীর শারীরিক সুস্থতার জন্য কাজ করে যান এমন নয়, তারা করেন মনুষ্য প্রজাতিকে বিলুপ্তি থেকে বাঁচানোর জন্য। ভারতীয় গুরু জাজ্ঞি ভাসুদেব, বর্তমানে ‘সেভ সয়েল’ নামক এক মুভমেন্ট করছে তার অনুসারীদের নিয়ে। তারা মাটিকে বাঁচাতে চায়, মাটির উর্বরতা ধরে রাখতে চায়। কিন্তু কেন? এই প্ল্যানেটের মাটি কি মানুষের দয়ার জন্য কান্নাকাটি করছে? না তো। তাঁরা মাটিকে বাঁচাতে চায় এজন্য যে, এর উর্বরতা নষ্ট হলে মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

অন্যান্য সংবেদনশীল প্রাণীরা কেন মানুষের মত পরিবেশের এত ক্ষতি সাধন করতে পারে না? সম্ভবত বুদ্ধিমত্তার তারতম্যের কারণে। তবে আমরা জোর গলায় বলতে পারি না যে অন্যান্য প্রাণী মানুষের থেকে কম বুদ্ধিমান। তবে এটুকু বলা যায় যে মানুষের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে প্রকৃতিতে ডেস্ট্রাকশন এবং অলটারেশন ঘটে বেশি। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অথবা শুধু মানুষের স্বার্থের বিবেচনায় দেখলে—মানুষের বুদ্ধিমত্তার এই বিধ্বংসী বৈশিষ্ট্য থাকাটা মানুষের সারভাইভালের জন্য বেশ জরুরী। কারণ, মনুষ্য ইন্টেলিজেন্সের টিকে থাকা এবং রিপ্রোডাকশনকে স্কেল আপ করার জন্য তার ক্রাইসিস ভীষণ প্রয়োজন। প্রয়োজন মন্দের উপস্থিতি, প্রয়োজন যন্ত্রণারও। ক্রাইসিস থাকলে, মন্দ থাকলে, যন্ত্রণা থাকলে সেটাকে ওভারকাম করার জন্য কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়—কাজ না থাকলে এই সাধের জীবন লইয়া এত বড় মস্তিষ্কের অধিকারী মানব প্রজাতি আর করবেটা কী?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *