মানুষের সুখী হওয়ার বেশকিছু প্রতিষ্ঠিত পন্থা রয়েছে। এসবের মধ্যে কে কোন পন্থা অনুসরণ করবে সেটা নির্ভর করে তার নিজস্ব জীবনবোধের উপর। কারণ, উদ্দেশ্য এক হলেও একেক পন্থার কলাকৌশল একেক রকম। সেগুলো কী সেটা জানার আগে একজন মানুষকে প্রথমেই বোঝা উচিৎ সুখ অনুভবে মনুষ্যমনের চরিত্র কেমন। সুখ সাধারণত আসে সন্তুষ্টি থেকে। আর সন্তুষ্টি আসে আমাদের মানসিক এবং শারীরিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এখানে একটা গভীর সমস্যা হল, মানুষের মন যখন কিছু একটা আকাঙ্ক্ষা করে, সেটা পাওয়ার পর খুব দ্রুত সে এটার উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আবার তাকে নতুন আরেকটা জিনিস পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মেতে উঠতে হয়। দু’জন সাইকোলজিস্ট এটার নাম দিয়েছেন ‘হেডোনিক এডাপটেশন’। তারা এক্ষেত্রে লটারি উইনারদের কথা উল্লেখ করেন। বিভিন্ন স্টাডিতে দেখা যায়, একজন বড় অংকের লটারি উইনার সাধারণত তার স্বপ্নের জীবনটাকে যাপন করার একটা সুযোগ পায়। কিন্তু প্রথম দিকে জীবন খুব আনন্দে কাটলেও লটারি জেতার কিছুদিন পর দেখা যায় জয়ী ব্যক্তির হ্যাপিনেসের মাত্রা তার লটারি জয়ের আগের সময়ের হ্যাপিনেসের সমান হয়ে যায়। তার কেনা নতুন ফেরারি গাড়ি, আলিশান বাড়ি আর নতুন লাইফস্টাইল কিছুদিন পরেই তার কাছে গ্র্যান্টেড হিসেবে ধরা দেয়। যেমন, শৈশবে আমরা চৌদ্দ ইঞ্চি সাদাকালো টিভিতে যখন মুভি দেখতাম, তখন আকাঙ্ক্ষা করতাম রঙিন টেলিভিশনের। রঙিন টেলিভিশন থেকে ধাপে ধাপে এখন দেয়াল জুরে বিগ স্মার্ট স্ক্রিনে মুভি দেখাটা এমনভাবে গ্র্যান্টেড হয়ে গেছে যে এখানে টেলিভিশন সংক্রান্ত হ্যাপিনেসের মাত্রা আগের থেকে বাড়েনি বরং কমেছে।
এটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার। জগতের সকল মনুষ্যমন এই ফাঁদে আটকা পড়ে থাকে অথবা এটাই মনুষ্যমনের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এমতবস্থায় সুখী হওয়ার উপায়?
এক্ষেত্রে ক্যাপিটালিস্টিক একটা উপায় হল, গোল-ড্রিভেন জীবন যাপন করা। অন্যকথায়, ‘ড্রিম বিগ’ টাইপের জীবন। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট স্বপ্ন অথবা লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেটা পূরণের জন্য কাজ করে যাওয়া, সেই লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেলে যখন একগেয়েমিতা চলে আসবে তখন আরেকটা নতুন লক্ষ্যের পেছনে ছোটা। এভাবে মৃত্যু পর্যন্ত কিছু না কিছু অর্জন করা কিংবা জমানোর পেছনে জীবনকে অতিবাহিত করা।
গডলেস স্পিরিচুয়ালিটিতে সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র হিসেবে দেখা হয় বর্তমান মুহূর্তে থাকাকে। অর্থাৎ অতীত আর ভবিষ্যৎ নিয়ে না ভেবে বর্তমান মুহূর্তটাতে মনোসংযোগ করে বর্তমানের সবকিছুকে উপভোগ করা। অতীত ইতিমধ্যে চলে গেছে, ভবিষ্যতে কী হবে তা কখনই কেউ জানে না, সুতরাং কেবল বর্তমান মুহূর্তেই মানুষ সুখী হওয়ার কিংবা পূর্ণতা পাওয়ার একমাত্র উপায় খুঁজে পেতে পারে।
গড নির্ভর অরগানাইজড রিলিজিয়নগুলোতে মানুষের পার্থিব সুখের উপর তেমন একটা জোর দেয়া হয় না, যেহেতু পার্থিব জীবন অতি ক্ষুদ্র এবং এর পরেই আছে অনন্তকালের আফটার লাইফ। তাই এখানে ঈশ্বর প্রদত্ত যা কিছু আছে সবকিছু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার উপায় হিসেবে আফটার লাইফের অর্জনকে স্মরণ করাটাকে মূল কৌশল হিসেবে ধরা হয়।
প্রাচীন স্টোয়িসিজমে সুখী হওয়ার অনেকগুলো কৌশলের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য কৌশল হল মনুষ্যমনের অসন্তুষ্টির প্যাটার্নটাকে এড্রেস করা। যেহেতু মানুষ যাকিছুই পায়, কোনকিছুতেই তার তুষ্টি মেলে না, আবার নতুন করে চায়, তাই এমন একটা উপায় বের করতে হবে যাতে করে মানুষ তার অলরেডি যা আছে সেটাকেই শুধু বারবার আকাঙ্ক্ষা করবে। এটা করার জন্যে স্টোয়িক দার্শনিকরা ‘নেগেটিভ ভিজুয়ালাইজেশন’ টেকনিক ব্যবহার করতে বলেন। যেমন, আপনি চিন্তা করবেন আপনার বাড়িতে আগুন লেগে গিয়ে আপনার যা ছিল সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আপনার এখন যা আছে সেগুলো পুড়ে গেলে আপনার কতটা খারাপ লাগবে সেটা চিন্তা করে আপনি সেগুলোকেই আকাঙ্ক্ষা করবেন। অথবা আপনি ভাববেন আজকের দিনটাই আপনার জীবনের শেষ দিন। এটা চিন্তা করে আপনি আজকের দিনের জীবনটাকে কৃতজ্ঞতার সাথে উপভোগ করবেন।
সুখী হওয়ার এসব উপায়ের যে কেউ যে-কোন একটা অনুসরণ করতে পারে অথবা সবগুলো থেকে একটু একটু করে নিয়ে মিক্স করে করতে পারে। সবকটাই হয়তো কাজের।
কিন্তু প্রশ্ন হল, মানুষকে কেন সুখী হওয়ার জন্যে চেষ্টা অথবা সাধনা করতে হয়? কেন মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই সুখী নয়? এমনতো হতে পারতো মানুষ যেভাবেই জীবনকে যাপন করুক না কেন, সে সুখেই থাকবে। এমন প্রশ্নের মুখে দার্শনিক আলবেয়ার ক্যামু হয়তো বলে উঠবেন, বাদ দেও। কোন যুক্তি খুঁজে পাবে না। জীবন অ্যাবসার্ড আর আমরা হলাম সিসিফাস। যতটুকু সম্ভব মরার আগ পর্যন্ত এই অ্যাবসার্ডিটিকে উপভোগ করে যাও। কি আর করা!