অস্তিত্বের চূড়ান্ত উদ্বেগ

মৃত্যু – সবচাইতে স্পষ্ট, সহজেই ধরা যায়, বোঝা যায় এমন এক চূড়ান্ত উদ্বেগ। আমরা এই আছি এখন এখানে, কিন্তু একদিন আর থাকবো না। মৃত্যু আসবে, এটা থেকে পালানোর কোন উপায় নাই। এটা একটা ভয়ংকর সত্য, যে সত্যের মুখের দিকে আমরা সহজে তাকাতে চাই না। স্পিনোজা বলেছিলেন, ‘সবকিছুই তার নিজের সত্তায় টিকে থাকতে চায়’ আর এখানে আমাদের অস্তিত্বের মূল দ্বন্দ্বটা হল মৃত্যু যে নিশ্চিত এই ব্যাপারে অবগত থাকা আর এটা জেনেও মরতে না চাওয়ার মধ্যকার গভীর পীড়ন।
স্বাধীনতা – তেমন একটা স্পষ্ট করে বোঝা যায় না এমন আরেকটা চূড়ান্ত উদ্বেগের নাম হল স্বাধীনতা। সাধারণত আমরা ধরে নেই যে স্বাধীনতা দ্ব্যর্থহীনভাবে একটা ইতিবাচক ব্যাপার। ইতিহাসের দিকে তাকালে কি দেখা যায় না যে মানুষ পুরো সময়টা ধরে কীভাবে আকুল হয়ে সংগ্রাম করেছে স্বাধীনতার জন্যে? অথচ চূড়ান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে দেখা যায় যে স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত ভয়ের সাথেই গজাল দিয়ে শক্ত করে গাঁথা। অস্তিত্বের দৃষ্টিতে “স্বাধীনতা” হল যে-কোন বাহ্যিক কাঠামোর অনুপস্থিতি। অর্থাৎ একজন মানুষ কোন জন্মগত তথা ঐশ্বরিক ডিজাইনের মহাবিশ্বে প্রবেশ করে না (এবং ত্যাগও করে না)। বরং, প্রতিটা মানুষ তার নিজের জগত, জীবনের নকশা, চয়েস এবং কর্মের জন্য নিজেই দায়ি, সে নিজেই নিজের জীবনের লেখক। “স্বাধীনতা”র যখন এই অর্থ, তখন এটার তাৎপর্যও ভয়ানকঃ যার অর্থ হল আমাদের পায়ের নিচে কোন মাটি নেই – কিছুই নেই, একটা শূন্যতা, একটা অতল গহ্বর। এখানে অস্তিত্ব-সম্বন্ধীয় আরেক দ্বন্দ্ব হল এই অতল গহ্বরের মুখোমুখি হওয়া, আবার অতলেই একটা তল এবং কাঠামো খুঁজে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করা।
অস্তিত্বগত একাকীত্ব – আমাদের তৃতীয় চূড়ান্ত উদ্বেগ হল একাকীত্ব। তবে সেটা আশেপাশে আপন মানুষের অভাববোধ থেকে উৎসারিত একাকীত্ব না, এমনকি নিজের কিছু অংশের সাথে নিজের অনুভূত বিচ্ছিন্নতার একাকীত্বও না, এটা একটা মৌলিক একাকীত্ব—যে একাকীত্বে ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন অনুভব করে সকল প্রাণী এবং প্রানিকুলে ঠাসা জগত উভয় থেকেই— যে একাকীত্ব ছিঁড়ে-ফেরে যায় অন্য সকল একাকীত্বের তলদেশ। আমরা একজন আরেকজনের যত কাছেই আসার চেষ্টা করি না কেন, একটা চূড়ান্ত, অপূরণীয় শূন্যস্থান থেকেই যায় আমাদের মাঝে; প্রত্যেকেই আমরা অস্তিত্বে প্রবেশ করি একা এবং আমাদেরকে এখান থেকে বেরও হতে হয় একা। এখানে অস্তিত্বগত দ্বন্দ্ব হল আমাদের চূড়ান্ত একাকীত্ব নিয়ে আমাদের অবগতি, আর একটু ছোঁয়া পাওয়া, নিরাপত্তা পাওয়া এবং নিজেকে বৃহত্তর সত্তার অংশ করে তোলার প্রবল ইচ্ছা।
অর্থহীনতা – চতুর্থ চূড়ান্ত উদ্বেগ অথবা অস্তিত্ব প্রদত্ত চিন্তা অনুভূতি হল অর্থহীনতা। যদি আমরা একদিন মরেই যাই, যদি আমাদের নিজেদের জগতের নির্মাতা আমরাই হই, যদি এই নির্দয় মহাবিশ্বে প্রত্যেকে আমরা একাই হই, তবে এই জীবনের অর্থ কী? আমরা বেঁচে থাকি কেন? আমরা বেঁচে থাকব কীভাবে? যদি আমাদের জীবনের পূর্বনির্ধারিত কোন নকশা থেকে না থাকে, তাহলে তো আমাদের নিজেকেই নিজের জীবনের অর্থ তৈরি করতে হবে। এখন, একজনের নিজের তৈরি করা অর্থ কি তার পূর্ণ জীবনের ভার বহন করার মত যথেষ্ট শক্ত? অর্থপ্রেমী মনুষ্য প্রাণীর এই অর্থহীন ব্রহ্মাণ্ডে এসে ছিটকে পড়াটাও অস্তিত্বের এক চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব।
অনুবাদ ।। শরিফুল ইসলাম
মূলঃ এক্সিজটেনশিয়াল সাইকোথেরাপি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *