প্লেটো আর অ্যারিস্টটলের চিন্তা যখন ইতোমধ্যে প্রাচীন গ্রীস দর্শনের চূড়ায়, তখন জন্ম হয়েছিলো এপিকিউরাসের। দার্শনিক চিন্তার মূল ফোকাস তখন অধ্যাত্মতত্ব থেকে সরে যাচ্ছিলো নীতিশাস্ত্রের দিকে—রাজনৈতিক নীতিশাস্ত্র থেকে ব্যক্তিগত নীতিশাস্ত্রের দিকে। যাইহোক, পূর্ববর্তী দার্শনিকদের অনুসন্ধান, যেমন মানুষের মৌলিক ধ্যান-ধারণা এবং মূল্যবোধের সত্যকে পরখ করা নিয়ে সক্রেটিসের চিন্তায় এপিকিউরাস খুঁজে পেয়েছিলেন নতুন চিন্তার বীজ।
মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ মনের প্রশান্তি অর্জন করা—এটাই ছিল এপিকিউরাসের দর্শনের মূল বক্তব্য। তিনি বলেন, জগতের সকল ভালো এবং মন্দের উৎস হল সুখ এবং দুঃখ, এবং সততা ও সুবিচারের মত গুণসমূহও উৎসারিত হয় এই উৎস থেকেই, যেমন “বিজ্ঞতার সঙ্গে, সম্মানের সাথে, ন্যায়পরায়ণ হয়ে জীবন ধারন করা ছাড়া একটা সুখের জীবন কাটানো অসম্ভব, আবার সুখে জীবন কাটানো ছাড়া বিজ্ঞতার সঙ্গে, সম্মানের সাথে, ন্যায়পরায়ণ হয়ে জীবন ধারন করাও অসম্ভব।” এপিকিউরাসের চিন্তাকে প্রায়ই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়—মনে করা হয় যে এপিকিউরাসের চিন্তা শুধু ইন্দ্রিয়গত সুখের পেছনেই ছুটেছিল। এপিকিউরাসের মতে, জগতে মহৎ সুখ অর্জিত হয় জ্ঞান, বন্ধুত্ব আর একটা পরিমিত জীবন ধারার মধ্য দিয়ে—যে জীবন দুঃখ আর ভয় থেকে মুক্ত।
মৃত্যুর ভয়
এপিকিউরাস বলেন, একটা মনের প্রশান্তি উপভোগ করার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হল মৃত্যুর ভয়—আর মরার পরে ঈশ্বর আমাদের পাপের জন্য কঠিন শাস্তি দেবেন এরকম ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে বাড়তে থাকে এই ভয়। এই ভয়কে মোকাবেলা করার জন্য অনৈতিক কোন বিকল্প উপায়ের প্রস্তাব না দিয়ে, এপিকিউরাস বরং মৃত্যু কী সেটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টায় মত্ত হয়েছিলেন। তিনি বললেন, মৃত্যু মুহূর্তে যেহেতু আমাদের চৈতন্য (আত্মা) অস্তিত্বহীন হয়ে যায়, তাই আমরা আসলে নিজের মৃত্যু সম্পর্কে অবগত থাকি না। এটাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এপিকিউরাস পরমাণু দার্শনিক ডেমোক্রিটাস এবং লিউকিপাস-এর কথা উল্লেখ করে বলেন, ব্রহ্মাণ্ড যেখানে পরমাণু আর শূন্য দ্বারা গঠিত, সেখানে আত্মা শূন্য হতে পারে না, কারণ একটা শরীরে আত্মা কাজ করে গতিশীল ভাবে। সুতরাং আত্মা অবশ্যই পরমাণু দিয়ে তৈরি। আত্মার পরমাণুগুলো সারা শরীরে বণ্টিত অবস্থায় থাকে, কিন্তু এগুলো যেহেতু অতি মাত্রায় ভঙ্গুর তাই মৃত্যুকালীন সময়ে এগুলো নিঃশেষ হয়ে যায়, আর আমরা হারাই সকল অনুভূতির ক্ষমতা। আপনি যদি মৃত্যুর সময় শারীরিক আর মানসিক ভাবে কোন কিছু অনুভব করার ক্ষমতাই হারান, তাহলে মৃত্যু ভয় দিয়ে জীবিত থাকাকালীন সময়টা নষ্ট করাটা বোকামি।
এপিকিউরাসের জীবদ্দশায় তার অনুসারীর সংখ্যা ছিল কম। কিন্তু যারা তাকে অনুসরণ করতো তারা ছিল অত্যন্ত অনুগত। বলা হয়ে থাকে যে ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করাতে তিনি জনপ্রিয় হননি। তার চিন্তা মূলধারার দর্শনের কাছে অবহেলিত হয়েছিলো শত শত বছর, কিন্তু আঠার শতাব্দীর দিকে এসে জেরেমি বেন্থাম এবং জন স্টুয়ার্ট মিল-এর চিন্তায় পুনরায় উঠে আসেন এপিকিউরাস। বৈপ্লবিক রাজনীতিতে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণায় প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এপিকিউরাসবাদঃ ‘জীবন, মুক্তি আর সুখের অন্বেষণ।’
অনুবাদ ।। শরিফুল ইসলাম
মূলঃ দ্যা ফিলসফি বুক