‘তোমাকে আমার ভয় করে, বুড়ো নাবিক!
ভয় করে তোমার ঐ হাড্ডিসার হাত!
তোমার সরু, ক্ষীণ আর বাদামী দেহ
ঠিক যেন সাগরের বুকে ভেসে উঠা সরু চর।
তোমাকে আমার ভয় করে, ভয় করে তোমার চকচকে চোখ,
তোমার হাড্ডিসার অতি বাদামী হাত।’—
ভয় নেই, ভয় পেওনা, হে বিয়ের-অতিথি
এ দেহটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
একা, একা, একেবারে, একদম একা,
বিস্তৃত সাগরের বুকে একদম একা!
আর কখনই কোনো সাধু এক ফোটা করুণা ঢালেনি
নিদারুণ যন্ত্রণায় কাতর আমার এই আত্মাটায়।
এতসব লোক, কত সুন্দর!
সবাই শুয়ে আছে, মৃতঃ
হাজারো চটচটে সরীসৃপ
বেঁচে আছে, আর বেঁচে আছি আমি।
চোখ রাখলাম পচন ধরা সাগরটায়
যত দূর দুচোখ যায়,
চোখ রাখলাম পচন ধরা ডেকের উপর
সেখানে শুয়ে আছে মৃতরা।
প্রার্থনা করার চেষ্টা করলাম, স্বর্গপানে চেয়ে,
কিন্তু কোন প্রার্থনার প্রবাহ গড়িয়ে বেরুলোনা ভেতর থেকে,
একটা দুষ্ট ফিসফিসানি ভেসে আসলো কানে, ভঁয়ে আমার
হৃদপিণ্ডটা শুকিয়ে গেলো ধুলোর মতই।
চোখের পাতা দুটি বন্ধ করলাম, বন্ধ করেই রাখলাম,
ধমনীর স্পন্দনের তালে কেঁপে উঠেছিলো চোখের তারাগুলো;
আকাশ আর সাগরটার জন্যে, এবং সাগর আর আকাশটা
তাঁদের সমস্ত ভার ঢেলে দিয়ে মরার মত শুয়ে পড়লো আমার শ্রান্ত চোখে,
আর আমার পদতলে শুয়ে ছিলো মৃতরা।
তাঁদের অঙ্গ থেকে গলে বেয়ে পড়ছিলো শীতল ঘাম,
পচন ধরেনি তাঁদের মরদেহে, কোন দুর্গন্ধও ছিলো নাঃ
মরার আগে আমার দিকে তাকানো যন্ত্রণায় কাতর চাহনিটা
কখনোই মুছে যায়নি তাঁদের চেহারা থেকে।
একটা এতিমের অভিশাপ জাহান্নামে টেনে নিতে পারে
একটা মহৎ আত্মাকে;
কিন্তু আহ! এর চেয়েও জঘন্য
মরার চোখের অভিশাপ!
সাতটা দিন, সাতটা রাত, আমি দেখেছি সে অভিশাপ,
তারপরও আমি মরতে পারিনি।
আকাশ বেয়ে চাঁদটা উঠে গেলো উপরে,
দাঁড়ায়নি সে কোথাওঃ
সে মৃদু পায়ে বেয়ে উঠছিলো,
সাথে ছিলো একটি অথবা দুটি তারা—
তাঁর উজ্জ্বল কিরণমালা ব্যঙ্গ করছিলো গুমোট বাতাসটাকে,
যেন এপ্রিলের ছড়িয়ে পড়া শুভ্র তুষার বিন্দু;
কিন্তু জাহাজের বিস্তৃত ছায়াটা শুয়েছিলো যেখানে
সম্মোহিত পানিটা পুড়ে পুড়ে হয়েছিলো
স্থির আর ধারণ করেছিলো ভয়ংকর লাল বর্ণ।
জাহাজের ছায়াটার বাইরে,
দেখলাম জলজ সাপ গুলোঃ
তাঁরা ভেসে বেড়াচ্ছিললো উজ্জ্বল শুভ্র পথে,
যখন তাঁরা পেছন ঘুরেছিলো, অশুভ আলোটা
গিয়ে পড়ছিলো তাঁদের ধূসর শরীরে।
জাহাজের ছায়াটার ভেতরে,
দেখলাম তাঁদের চমৎকার বহিঃসজ্জাঃ
নীল, উজ্জ্বল সবুজ, মখমলে কালো,
তাঁরা কুণ্ডলী পাকিয়ে সাঁতার কাটছিলো; প্রতিটা পথ
যেন এক একটা সোনালী আগুনের ঝলকানি।
ওহ সুখী জীবিত ক্ষুদ্র প্রাণী! কোন জিহ্বা নেই
তাঁদের সৌন্দর্য ঘোষণা দেয়ঃ
ভালোবাসার একটা স্রোত প্রবল বেগে বেরিয়ে আসছিলো আমার হৃদপিণ্ড থেকে,
আর আমি তাঁদেরকে আশীর্বাদ করেছিলাম অবচেতনেঃ
আমি নিশ্চিত আমার পছন্দের কোন সাধু দয়া করেছে আমার উপর
আর আমি তাঁদেরকে আশীর্বাদ করেছিলাম অবচেতনে।
আমি প্রার্থনা করতে পেরেছিলাম সেই একই মুহূর্তে,
আর আমার ঘাড় থেকে খুলে পড়লো
মরা অ্যালবাট্রসটা, এবং ডুবে গেল
সাগরটায় ঠিক সিসার মত।
চতুর্থাংশের সমাপ্তি (চলবে…)
মূলঃ দ্যা রাইম অব দ্যা এইনশানট মেরিনার — স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ