স্যানিটি, ভায়োলেন্স এবং দ্য ভেজিটেরিয়ান

মানুষের স্যানিটি আর ইনস্যানিটির মধ্যকার যে পার্থক্য—এই দুটো মানসিক অবস্থানের মধ্যবর্তী স্থানে যেটা থাকে, সেটা একটা থিন লাইন। একটা সুতো। যে যতদিন এই সুতোটা ধরে রাখতে পারে, সে ততদিন নিজেকে উন্মাদ হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। ক্ষণে ক্ষণে এই সুতোটা আমরা সকলেই অবশ্য হারিয়ে ফেলি কিংবা সুতোটা ঠিক আমাদের হাতেই থাকে, কিন্তু আমরা সে কথা ভুলে যাই। যখন আবার মনে পড়ে—যখন আমাদের সম্বিত ফিরে আসে—যখন আমাদের মাথায় তথাকথিত বাস্তবতা এসে আঘাত হানে, তখন—ঠিক তখন আমরা সুতোটায় পুনরায় হুক্‌ড হই—ঠিক তখন ফিরে আসে আমাদের মতিস্থিরতা।

মতিস্থিরতা। আমরা যারা জীবনভর এই মতিস্থিরতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে পারদর্শী, তাদেরও এটা হারিয়ে যাবার উপক্রম হয় বারংবার। সুতোটা বড্ড সরু। সুতোর এপারে আছি আমরা, আছে আমাদের সমাজ, আমাদের কৃষ্টি কালচার। এই সুতো শক্ত হাতে ধরে আছি বলেই জাগ্রত অবস্থায় আমরা ন্যাংটো হয়ে পাবলিক বাসে উঠে পড়ি না কিংবা ছাত্র হয়ে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের গালে চড় মেরে বসি না কিংবা পায়খানায় গিয়ে দরজা খোলা রেখে পটি করা শুরু করি না। কিন্তু যখন আমরা জেগে থাকি না—যখন ঘুমিয়ে পড়ি—যখন ঘুমের দেবতার হাতে কিছু সময়ের জন্য তুলে দেই আমাদের সুতোটা, তখন আমাদের স্বপ্নের জগতে মতিস্থিরতার আর কোন ঠিকঠিকানা থাকে না। তখন—স্বপ্নজগতে—প্রায়ই আমরা ভরা মজলিশে নিজেকে আবিষ্কার করি ন্যাংটো অবস্থায় কিংবা বড্ড নিরীহ হয়েও আমরা মেতে উঠি খুনখারাবিতে কিংবা যৌনতায় নেমে পড়ি সমাজ নিষিদ্ধ মানব অথবা মানবীর সাথে—তখন আমরা সুতোর ওপারে চলে যাই, যদিও আমরা জানি ঘুম ভাঙলেই আবার ফিরে আসবো এপারে।

সুতোর ওপারের যে জগৎ কিংবা আমরা উন্মাদ হয়ে গেলে যে জগতের দেখা পাই, সেটা কত বৃহৎ, কত বিচিত্র, কত উদ্ভট সম্ভাবনাময় তা আমরা সকলেই কিছুটা আঁচ করতে পারি। আঁচ করতে পারি বলেই সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে আমাদের এত ভয়। তবুও আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এই ভয়টা পাই না কিংবা কেউ কেউ চাইলেও আর এপারে থেকে যেতে পারি না। ভয় নাকি ইচ্ছা, এখানে ঠিক কোনটা ঘটে আমরা তা জানি না। যেটা জানি, ওপারে একেবারে চলে গেলে আমাদের এপার হারাতে হবে। তবে ওপারে যে রিয়্যালিটি আছে, তা যতই উদ্ভট আর বিশাল হোক, এর মানে এই নয় যে এপারেরটা কোন অংশে ছোট কিংবা কোন অংশে কম উদ্ভট। দুটো জগতের স্রষ্টা তো এই আমরাই।

মানুষ স্রষ্টা হলেও বড্ড ভঙ্গুর, বড্ড ভীত। তার হাতে সুতোর নিয়ন্ত্রণ প্রায়ই থাকে না। এই না থাকার কারণে কোন্‌ জগতে সে বেঁচে আছে তা জানে না কিংবা আদৌ বেঁচে আছে কিনা তাও তার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। এই প্রশ্নের উত্তর মানবের কাছে ধরা দেয় দুটো উপায়েঃ ভায়োলেন্স আর ইনোসেন্স। যে জগতে যেতে আমি ভয় পাই, সেখানে অন্য কাউকেও যেতে দিতে না চাওয়া, সে জগতের ভয়াবহতা থেকে অন্যকে জোরপূর্বক বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টাই হলো ভায়োলেন্স। আর ইনোসেন্স—যে তীব্র তাড়না আমাকে খেয়ে ফেলতে চায়—যে তাড়নার উদ্দেশ্য শুধু মামুলী ক্ষতিসাধন নয়—যে তাড়না আমার সকল চিন্তা আর ভাষাকে মুছে দিতে চায় চিরতরে, সে তাড়নায় সাড়া দেয়া।

হ্যান কাং-এর উপন্যাস দ্য ভেজিটেরিয়ান-এর ইয়োং-হাই একজন মানুষ, যার মতিস্থিরতার সুতোটা স্থায়ীভাবে হারিয়ে গেছে। এপারের ইয়োং-হাই আর মানুষ হয়ে থাকতে চাচ্ছে না। সে হয়ে যেতে চাচ্ছে বৃক্ষ। কেন? সেটা সে কখনই বলে না। এখানে বলারও তেমন কিছু নেই। যে মানুষ গাছ হয়ে যেতে চায়, তার কাছে প্রথম অপ্রয়োজনীয় জিনিসই হলো ভাষা আর চিন্তা—যে ভাষা আর চিন্তা মানুষের, গাছের নয়। তবে ইয়োং-হাই কেবল একটা কথা বলে। সে বলে একটা স্বপ্নের কথা। “আই হ্যাড অ্যা ড্রিম”।

আমাদের সুতোর নিয়ন্ত্রণ থাকে না যে স্বপ্নে, সে স্বপ্নের বাস্তবতাকেই ইয়োং-হাই-এর কাছে লোভনীয় মনে হচ্ছে। সে স্বপ্নের বাস্তবতায় কিংবা সুতোর ওপারের স্থায়ী বাসিন্দা হতে চেয়ে প্রথমেই সে মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এক পর্যায়ে সে বন্ধ করে দিয়েছে সকল প্রকারের খাবার খাওয়াও। গাছেরা তো খাবার খায় না। শুধু জল আর সূর্যের আলো খায়। ফটোসিনথেসিস। ইয়োং-হাইও তাই করে। আর এটা দেখে—সবুজ আনন্দে—জ্বলজ্বল করে উঠে অরণ্যের সকল বৃক্ষরা।

Comments

comments

5 views

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *