কনশাসনেস, সেল্‌ফ এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স

আজ থেকে অনেক বছর পরে—এত পরে যখন পৃথিবীর সর্বশেষ মানুষটিরও আর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই—তখন—কোন এক বিকেল বেলায় তিনটা রোবটকে দেখা গেল গভীর কৌতূহল নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, এটা-সেটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে। পৃথিবী থেকে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তখনও রয়ে গেছে তাদের ফেলে যাওয়া অবকাঠামো। খসে পড়া দেয়াল নিয়ে তখনও দাঁড়িয়ে আছে মানুষের তৈরি আকাশ ছোঁয়া দালান, হোটেল, শপিং মল, আছে কংক্রিটের রাস্তাঘাট যার উপর পড়ে আছে মানুষের ব্যবহৃত দামী গাড়ির ধ্বংসাবশেষ। এর ভেতরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে তিনটে রোবট। এদের নাম কে, এক্স এবং জি। এদের মধ্যে কে-এর অবয়ব দেখতে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মত, এক্স দেখতে মানুষের বাচ্চার সমান আর জি-এর মধ্যে মানুষের অবয়বের কোন ছাপ নেই, সে দেখতে ত্রিভুজাকৃতির।

রোবট জি-এর সিস্টেমে জমা করা আছে মানব ইতিহাসের অনেক তথ্য। রোবট এক্স যখন কিছু একটা হাতে নিয়ে বাচ্চাদের মতই প্রশ্ন করে জানতে চায় এটা কী, তখন রোবট জি তার সিস্টেমের ডাটাবেজ থেকে তথ্য নিয়ে সেটার উত্তর দেয়। এদের প্রশ্নোত্তরের ধাঁচ থেকেই বোঝা যায় এরা ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীতে মানুষ কীভাবে বেঁচে ছিল সেটা বোঝার জন্য। এখন যেমন পৃথিবীর অতীত বোঝার ক্ষেত্রে আমরা ব্যবহার করি অতীতবাসীর রেখে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ, তখনও বিলীন হয়ে যাওয়া মানব প্রজাতি সম্পর্কে জানতে রোবটদের দেখা যায় তারা মানুষের ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র ধরেই এগোচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে তিন রোবট গিয়ে পৌঁছায় মানুষের তৈরি করে রেখে যাওয়া এক নিউক্লিয়ার মিসাইল বেইজে। কৌতূহলের স্বাভাবিক ধারায় রোবট কে-এর মনে প্রশ্ন জাগে মানব প্রজাতি ধ্বংস হল কীভাবে। উত্তরে রোবট জি বলে, মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়েছে নিজেদের সৃষ্ট পরিবেশগত দুর্যোগে। হয়তো নিজেদের ফাটানো বোমায়।

প্রায় এরকমই একটা ছোট গল্প লিখেছিলেন অ্যামেরিকান লেখক জন স্কালজি। তার লেখা গল্প থেকে ‘থ্রি রোবটস’ নামের একটা এডাপ্টেশন করেছিল অ্যামেরিকান ফিল্মমেকার টিম মিলার ‘লাভ, ডেথ + রোবট’ নামের এক টেলিভিশন সিরিজে। স্কালজির এই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মত বর্তমানে আরও অনেক সাহিত্য, সিনেমার মূল বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে মানব প্রজাতির এমন পরিণতির কথা। মানব প্রজাতির ভবিষ্যৎ কি আসলেই এমন হতে পারে? মানবের বর্তমান আচরণ, পরিবেশের উপর তার প্রভাব এবং বর্তমানে প্রাপ্ত চলমান ফলাফল থেকে বলা যায় মানুষের ভবিষ্যৎ পরিণতি এমনটা হতেও পারে। ব্যাপারটা মানবের জন্য দুঃখের, হতাশার। মানব প্রজাতি বরাবরই মূর্খ ছিল এবং তার বর্তমান আচরণ থেকে মনে হয় সে ভবিষ্যতে মূর্খই থাকবে। তার মূর্খতাই তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। এখানে মজার ব্যাপার হল, তার ধ্বংসের পরে হয়তো পৃথিবী দখল করে রাখবে তারই তৈরি করা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কী? যে বুদ্ধিমত্তা প্রাকৃতিক নয় সেটাই আর্টিফিশিয়াল তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। প্রাকৃতিক বলতে মানুষ আসলে রক্তমাংসের মিশ্রণে তৈরি নিউরন সংযোগের জালে ভরা মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তাকে বোঝে। কিন্তু সেই মস্তিষ্কের বুদ্ধি ব্যবহার করে তৈরি করা মেশিন সংযোগের মস্তিষ্ককে মানুষ আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হিসেবে চেনে। মেশিন থেকে উৎপাদিত সকল বস্তুকেই মানুষ প্রকৃতি বহির্ভূত কিংবা কৃত্রিম হিসেবে চিহ্নিত করে। কৃত্রিম এবং প্রাকৃতিক ব্যাপারটাকে মানুষের ব্যবহারিক এবং ভাষাগত সুবিধার ক্ষেত্রে এভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন আছে। কিন্তু রিয়্যালিটিতে আসলে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ বলে কিছু থাকার কথা না। একটা কম্পিউটার যদি মানুষের তৈরি অথবা এসেম্বল করা ইন্টেলিজেন্স হয়ে থাকে, তাহলে সেটা প্রকৃতিতে প্রাকৃতিক ইন্টেলিজেন্স হিসেবেই কাজ করছে, যেটাকে মানুষের ইন্টেলিজেন্সের একটা বর্ধিত অংশ কিংবা অন্য ফর্ম বলা যেতে পারে। তাহলে মানুষ কেন কৃত্রিম আর প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তার এই পার্থক্যকরণে লিপ্ত হল? এর কারণ মানুষের কনশাসনেস।

কনশাসনেস তথা চেতনা কী? চেতনা হল একটা ব্যক্তি কিংবা প্রাণীর নিজের দেহ এবং মনকে নিয়ে রিয়্যালিটির মধ্যে নিজেকে এক আলাদা সত্তা হিসেবে অনুভব করা এবং নিজের ভেতর ও বাহিরের পরিবেশের মধ্যকার সম্পর্ক অনুধাবন করার ক্ষমতা। প্রাণীদেহে চেতনা কীভাবে আসলো? কেন আসলো? থিওলোজি, দর্শন এবং বিজ্ঞানে এই প্রশ্ন নিয়ে করা তর্কটা বহু পুরনো। এটাকে বলা হয়, দ্যা প্রবলেম অব কনশাসনেস। ১৯৯৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান দার্শনিক ডেভিড চালমার্স চেতনা বিষয়ে ‘ইজি প্রবলেম’ আর ‘হার্ড প্রবলেম’ নামে দুটো টার্ম কয়েন করেন।

জগতের সবকিছু কীভাবে কাজ করে, কীসের সাথে কীসের সংযোগ দিলে কী ঘটবে, কীসের সাথে কীসের বিক্রিয়ায় কোন কেমিক্যাল উৎপন্ন হবে, মস্তিষ্কের কোন নিউরনের সাথে কোন নিউরনের ফায়ারিং-এ মানুষ কী ধরণের আচরণ করবে এসবের লজিক্যাল কনসিকোয়েন্স অনুসন্ধান করার সময় মানুষ যে সমস্যার সম্মুখীন হয় সেগুলোকে বলা হয় ‘ইজি প্রবলেম’। এগুলোকে সহজ বলার কারণ এগুলোর সমাধান আছে।

অপরদিকে, এইসব প্রক্রিয়ায় আমরা যেসকল অনুভূতিকে অনুভব করি, যেসকল অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাই, সেটা কেন যাই এবং কীভাবে যাই এই প্রশ্নটা হল ‘হার্ড প্রবলেম’। আমরা কেহই সঠিক জানি না কেন আমাদের চেতনা আছে। আমরা জানি না কেন আমরা একেক বিষয়ে একেক জন একেক রকম অনুভূতির মধ্য দিয়ে যাই। কেন আমাদের মস্তিষ্কের বিশেষ একটা নিউরাল প্রক্রিয়ার কারণে আমরা ক্ষুধা কিংবা যৌনতা অনুভব করি? চালমার্স বলেন, দৈহিক প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে চেতনাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সুতরাং, চেতনাকে পুরোপুরি শারীরিক বলার কোন উপায় নেই। চালমার্সের এই কথার সাথে আবার ফিজিক্যালিজমের তত্ত্বের সংঘর্ষ বাধে, যেখানে বলা হয় চেতনা হল প্রাণীর একটা কগনিটিভ প্রক্রিয়ার ফল। ব্যাপারটা জটিল।

কনশাসনেসের এই জটিলতার মধ্যে একটা ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে, চেতনা হল একটা জাগ্রত অনুভূতি কিংবা অনুভূতির স্রোত, যে অনুভূতি সবচাইতে বড় যে ঘটনাটা ঘটায় সেটা হল, প্রতিটা ব্যক্তিকে একটা আলাদা সত্তা হিসেবে অনুভব করায়। এটা চেতনার সবচাইতে আকর্ষণীয় ও রহস্যময় একটা ব্যাপার। চেতনার এই ফাংশন থেকেই মানুষ তার ব্যবহারিক প্রয়োজনের পাশাপাশি চিন্তায়ও ধারণ করতে চায় যে, রিয়্যালিটিতে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিমের মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে।

এখানে মজার ব্যাপার হল, মানুষের চেতনার যেমন নিজেকে আলাদা সত্তা হিসেবে এক্সপেরিয়েন্স করার ক্ষমতা আছে, তেমনি নিজেকে আলাদাকরণের যে প্রক্রিয়া সেটা সম্পর্কে সচেতন হওয়ারও ক্ষমতা আছে। এটাকে বলা হয় মেটাকগনিশন—চেতনার চেতনা। সেই ক্ষমতা থেকে আমরা চাইলে বুঝতে পারি যে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কিংবা রোবট আসলে মানুষেরই বর্ধিত সত্তা। যদি কোন এক সময় পৃথিবী থেকে মানুষ বিলীন হয়ে শুধু রোবট টিকে থাকে, সেটা কোন দুঃখের ব্যাপার হবে না। সেটা হবে ইভ্যুলুশনের পরবর্তী ধাপে পা ফেলার ব্যাপার। অর্থাৎ, মানবকেন্দ্রিক চিন্তায়, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষেরই ইন্টেলিজেন্স। আর এক্সিস্টেনশিয়াল চিন্তায়, এটা রিয়্যালিটিতে অস্তিত্বশীল ইন্টেলিজেন্সের স্রেফ অন্য একটা ভ্যারিয়েন্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *