প্রাণের নাশ এবং সাইক্লিক্যাল রিয়্যালিটি

ভিয়েতনামিজ আধ্যাত্মিক গুরু থিচ নাট হানের মা মারা যাওয়ার পর প্রায় বছর দেড়েক তিনি গভীর শোকে আচ্ছন্ন ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর মত এমন ব্যথা তিনি তার জীবনে আর কোনকিছুতেই পান নি। মা ছিল, এখন আর নেই, এই বিষয়টা তার মন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। একটা মানুষ ‘ছিল’ থেকে কীভাবে ‘নাই’ হয়ে যেতে পারে এটা তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। ভারাক্রান্ত চিত্তে এক রাতে তিনি তার মাকে স্বপ্ন দেখেন। মায়ের পাশে বসে গল্প করেন। স্বপ্নটা তার জন্যে এতটাই সুখকর ছিল যে, সেই রাতের পর থেকে তার আর কোনদিন মনে হয়নি যে মা নেই। তার মনে হচ্ছিলো, যে দেহটা নিয়ে সে বেঁচে আছে সেটা কেবল তার নিজের দেহ নয়, এটা তার বাবা-মা এবং সকল পূর্বপুরুষের জ্যান্ত চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। হাঁটার সময় প্রতি পদেই তার মনে হচ্ছিলো, তার পা দুখানি শুধু তার নিজের পা নয়, এগুলো তার মায়েরও পা, তার পূর্বপুরুষেরও পা। স্বপ্নটা দেখার পর থেকে তিনি বলতে থাকেন, আমি আর আমার মা একই পা’য়ে এই সোঁদা মাটির উপরে হেঁটে বেড়াচ্ছি। মা আমার মরে নাই।

সাইকোলজিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হানের দেখা এই স্বপ্ন আর স্বপ্ন পরবর্তী চিন্তাধারাকে মারাত্মক শোকের মধ্যে থাকাকালীন মেন্টাল কোপিং ম্যাকানিজম বলা যায়। মানুষের সাইকোলজিক্যাল ইমিউন সিস্টেম যেকোন গভীর শোক থেকে নিজেকে বের করে আনার জন্য এমন একটা ম্যাকানিজম তৈরি করে নেয়। সবার মস্তিষ্কই এই ম্যাকানিজমের মাধ্যমে সারভাইভ করে। তবে হানের মা মরে নাই তার এই দাবিটা আরেকটু জটিল। কারণ, মৃত্যু নিয়ে হানের প্রদত্ত ব্যাখ্যা সাইন্টিফিক্যালি খুবই ইন্টারেস্টিং।

হানের মতে, এই জগতে কোনকিছুরই একেবারে নাই হয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এই যে শীতের বরফে ঢেকে গিয়ে প্রকৃতির চারিদিক এমন বিষণ্ণ নিষ্প্রাণ হয়ে যায়, সেই একই প্রকৃতি বসন্তে আবার ফুলে-ফলে আর প্রাণে ভরে উঠে, এই প্রাণের স্পন্দন শীতকালে কোথায় চলে যায়, আর বসন্তে কোথা থেকে আসে? সব তো এখানেই লুকিয়ে থাকে, আবার এখান থেকেই উদয় হয়। রিয়্যালিটিতে যত ধরণের প্রাণ, অপ্রাণ, বস্তু-অবস্তু আর শব্দ-নীরবতা অস্তিত্বশীল থাকা সম্ভব, তার সবই এই মুহূর্তে এখানেই আছে, ছিল এবং ভবিষ্যতে এখানেই থাকবে। এখানে কখন কোন জিনিসটা দেখা যাবে, ধরা যাবে আর অনুভব করা যাবে সেটা নির্ভর করে বিশেষ ‘কন্ডিশন’-এর উপর। ব্যাপারটা কেমন?

ধরুন, আপনি হাতে একটা দেশলাই নিয়ে রান্নাঘরে চুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আগুন ধরাবেন। দেশলাইয়ের কাঠিটা যখন আপনি ম্যাচ বক্সের সাথে ঘষা দেবেন, তখনই আগুনটা জ্বলে উঠবে। ঘষা দেয়ার আগে কিন্তু আপনার সামনে কোন আগুন ছিল না, কাঠি আর ম্যাচ বক্সের বারুদের ঘষায় আগুনটা অস্তিত্বশীল হয়েছে। এই আগুনটা কোথেকে আসলো? আগুনটা কি আগে থেকেই এখানে ছিল না? ছিল। কেবল বারুদের ঘষায় এমন একটা কন্ডিশন তৈরি হয়েছে যা আগে থেকেই অস্তিত্বশীল থাকা সুপ্ত আগুনকে জ্বলন্ত রূপ দিয়েছে। আবার ফুঁ দিলে আগুনটা নিভে কোথায় যাবে? আগুনের জ্বলে থাকার কন্ডিশনটা নাই হয়ে যাবে।

আবার ধরুন, আপনি আপনার ঘরে বসে কথা বলছেন। আপনি যদি নিচু স্বরের মানুষ হন, তাহলে আপনার কথার আওয়াজ আপনার ঘরের বাইরে থেকে কেউ শুনতে পাবে না। আর যদি আপনি উঁচু স্বরের মানুষও হন, বড়জোর সেই আওয়াজ আশেপাশের কয়েক ঘর কিংবা বাইরে থেকে শোনা যেতে পারে। কিন্তু কিছুতেই আপনার গলার আওয়াজ আপনার পাশের শহর থেকে শোনা যাবে না কিংবা পাশের দেশ থেকেও না। কারণ, অত দূর কারও গলার আওয়াজ পৌঁছায় না। কিন্তু আপনি যদি গলার এই আওয়াজ নিয়ে একটা রেডিও স্টেশন কিংবা ফোন কলে কথা বলেন, তাহলে সেটা পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে শোনা যাবে। সেক্ষেত্রে আপনার শব্দগুলোকে ক্যাচ করার জন্য অপর প্রান্তে আরেকটা রেডিও কিংবা মোবাইল ডিভাইস কানেক্টেড থাকা লাগবে। এখানে আসলে কী ঘটে? আপনি যখন যেখান থেকেই কোন শব্দ উচ্চারণ করেন না কেন, সাথে সাথেই সেটা পুরো ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। আপনার এই উচ্চারিত শব্দকে শোনার জন্য দুটো কন্ডিশন প্রয়োজন। এক, আপনার শব্দের ডেসিবলের রেঞ্জ আর শ্রোতার কর্ণের হার্জ অনুযায়ী আশেপাশের মানুষ কিংবা প্রাণীরা সেটা শুনতে পাবে; দুই, ব্রহ্মাণ্ডের যেকোন জায়গা থেকে মোবাইল অথবা রেডিওর মত উপযুক্ত ডিভাইস দিয়ে সেটা শুনতে পাওয়া যাবে। যদি আপনার গলার শব্দ উচ্চারণের সাথে সাথেই সেটা পুরো ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে না পড়তো, তাহলে দুই নম্বর উপায়টা কাজ করতো না।

ঠিক এভাবেই রিয়্যালিটির সকল ভার্সন এই মুহূর্তে কিংবা সকল মুহূর্তে সবখানেই অস্তিত্বশীল। সেই হিসেবে আজ থেকে মিলিয়ন বছর আগে কে কী কথা বলে গেছে সেটা এখনও রিয়্যালিটিতে রেকর্ডেড অবস্থায় ভেসে বেড়াচ্ছে, যেটা শোনার জন্য দরকার শুধু একটা উপযুক্ত ডিভাইস। হয়তো সেই ডিভাইস মানুষ একসময় বানিয়ে ফেলতে পারে আবার নাও পারে। যেহেতু এখনও মানুষ সেটা বানাতে পারে নাই, তাই এটা এখনও সাইন্স ফিকশন। এই চিন্তা প্রসূত বেস্ট সাইন্স ফিকশন সিরিজটা তৈরি করেছেন অ্যামেরিকান ডিরেক্টর অ্যালেক্স গারল্যান্ড। নাম, ডেভস্‌ (২০২০)। ‘ডেভ’ শব্দটা এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘ডেউস’ থেকে, যার অর্থ ঈশ্বর।

সিরিজে দেখা যায়, যেহেতু রিয়্যালিটিতে এই মুহূর্তে সবকিছু এক্সিস্ট করছে, সেই চিন্তা থেকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কোম্পানির এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এমন একটা ডিভাইস তৈরি করেন যেটা দিয়ে তিনি ক্রুশবিদ্ধ যিশু খৃস্টের বলে যাওয়া কথাগুলোকে অডিবল করে তোলেন।

যদি রিয়্যালিটিতে সবকিছুই একই সময়ে অস্তিত্বশীল হয়, তাহলে থিচ নাট হানের মা আসলেই মরে নাই। কেহই কখনও মরে না। মরে না বলতে একেবারে অস্তিত্বহীন হয় না। এটা ভেবে আপনি যখন একটু ভালো অনুভব করতে চাইবেন, তখনই রিয়্যালিটির এই সূত্র ধরে আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়বে ডিটারমিনেজম আর ফ্রি উইলের মধ্যকার কঠিন এক দ্বন্দ্ব। সবকিছুই কি আগে থেকে ঠিক হয়ে আছে? অথবা সবকিছু কি একটা ইনফিনিট র‍্যানডম ভ্যারিয়েবলের চেইনে আমাদের ইচ্ছার বাইরেই ক্রিয়াশীল? আমাদের কি কোন স্বাধীন ইচ্ছা আছে? আমি কি নিজের ইচ্ছায় এই লেখাটা এতক্ষণ লিখলাম? জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার একবার বলেছিলেন, “ম্যান ক্যান ডু হোয়াট হি উইল্‌স, বাট হি ক্যাননট উইল হোয়াট হি উইল্‌স।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *