যখন আপনি আপনার প্রিয়তমার স্নিগ্ধ মুখের দিখে মুগ্ধ নয়নে অপলক তাকিয়ে আছেন, তখন যদি দেখতে পান যে, তার ডান গালে কিংবা কপালে কিংবা চিবুকে কিংবা গলা থেকে বুকের দিকটায় একটা কালো গর্ত দৃশ্যমান হয়ে আছে, এতে আপনার মুগ্ধ হওয়ার প্রবাহটায় একটু ছেঁদ পড়তে পারে অথবা অনেকটাই। কিন্তু আপনি তো এমন গর্ত দেখতে পান না। অথচ চোখের শারীরিক ফাংশন অনুযায়ী একটা গর্ত আপনার দেখতে পাওয়ার কথা।
আমাদের চোখের সাথে মস্তিষ্কের যে সংযোগ সেটা ঘটে চোখের রেটিনার ঠিক পেছনের একটা জায়গায়। মস্তিস্ক থেকে বেশকিছু অপ্টিক্যাল নার্ভ রেটিনার পেছনে একটা জায়গায় এসে একত্রিত হয়ে অক্ষিগোলকে ঢুকে পড়ে। নার্ভের ওই একত্রিত হওয়া জায়গাটা কোন দৃশ্য ধারণ করতে পারে না, অর্থাৎ চোখের শুধু ওই জায়গাটায় কোন ভিজুয়াল রিসেপ্টর নেই। এটাকে বলা হয় ব্লাইন্ড স্পট।
আপনি যখন আপনার প্রিয়তমার দিকে তাকিয়ে আছেন, তখন তার পুরো ভিজুয়ালটা আপনার চোখ রেজিস্টার করতে পারছে না ব্লাইন্ড স্পটের কারণে। যে জায়গাটা চোখ রেজিস্টার করতে পারে না, আপনার মস্তিস্ক সে জায়গাটাকে তার চারপাশ থেকে সংশ্লিষ্ট তথ্য এনে পূরণ করে দেয়। অনেকটা ফটোশপ করার মত। আর সেজন্যেই আপনি আপনার প্রিয়তমার অবয়বে কোন কালো গর্ত দেখতে পান না। সারাজীবনই আমাদের মস্তিষ্ক আমাদেরকে এভাবে ফটোশপ করা দৃশ্য দেখিয়ে যায়। আমাদের মস্তিষ্কটা এতই ভালো।
মস্তিষ্কের এই ভালো স্বভাবটা যে শুধু চোখের ব্লাইন্ড স্পটেই সীমাবদ্ধ থাকে তা নয়—আমাদের চিন্তায়, পারসেপশনে বড় বড় ব্লাইন্ড স্পট সে ফটোশপ করে পূরণ করে দেয় প্রতিনিয়ত। এবং এক্ষেত্রে এসে মস্তিষ্ক যে আমাদের খুব একটা উপকার করে সেটা জোর গলায় বলা যায় না। কারণ, চোখের ব্লাইন্ড স্পটে ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ডের দৃশ্য ফটোশপ করলে সেটা মোটামুটি নির্ভুল হয়, কিন্তু মানুষের চিন্তা আর বিশ্বাসে যেসব ব্লাইন্ড স্পট বিদ্যমান সেগুলো পূরণের সময় মস্তিষ্ক একেক ব্যক্তিকে তার ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে একেক রকম রিয়্যালিটি তৈরি করে দেয়। বেশিরভাগক্ষেত্রেই ব্যক্তি সেটা টের পায় না। তাই সে তার নিজের দেখা জগতটাকে অবজেক্টিভ মনে করে, তার জানা জ্ঞানকে সত্য মনে করে।
দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট তার আইডিয়ালিজমের থিওরিতে বলেছিলেন, আমরা ফিজিক্যাল ওয়ার্ল্ডে যা দেখি সেগুলো দিয়ে আমাদের পারসেপশন তৈরি হয় এমন নয়। বরং আমরা যা চিন্তা করি, যা অনুভব করি, যা আকাঙ্ক্ষা করি, যা বিশ্বাস করি সেগুলো ব্যবহার করেই মস্তিষ্ক আমাদেরকে একটা রিয়্যালিটি তৈরি করে দেখায়। তার মতে, মানুষের পক্ষে কখনই রিয়্যালিটিকে হুবুহু দেখা সম্ভব নয়। আমরা কখনই জানতে পারবো না জগতে আমরা যে দেখি, যা বিশ্বাস করি, যা চিন্তা করি সেগুলোর কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা।