সাইকোলজিক্যাল ইমিউন

মাছের মধ্যে বেশ কিছু প্রজাতি আছে যেগুলোর শারীরিক গ্রোথ সারাজীবন ধরে চলতে থাকে। অর্থাৎ, একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন পেলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এরা গায়ে-গতরে বাড়ে। যেমন, নাইল পার্চ নামে আফ্রিকান একটা মাছ আছে, পূর্ণ জীবন পেলে যেটার দৈর্ঘ্য প্রায় সাত ফুটের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। এসব মাছের শারীরিক গ্রোথ অল্প বয়সে অনেক দ্রুত ঘটলেও শেষের দিকে গিয়ে অনেক ধীর হয়ে আসে। তবে ধীর হলেও এরা বাড়ে, পুরো জীবন জুরে বাড়ে। এটাকে বায়োলজিতে ‘ইনডিটারমিনেট গ্রোথ’ বলা হয়। কিন্তু স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এই গ্রোথ দেখা যায় না। স্তন্যপায়ীদের মধ্যে, যেমন, মানুষের শরীর একটা নির্দিষ্ট ফর্মে পৌঁছানোর পর আর বাড়ে না।

শারীরিকভাবে সকল স্তন্যপায়ীদের ইনডিটারমিনেট গ্রোথের সুযোগ না থাকলেও, মানুষের গ্রোথের সম্ভাবনা থাকে মৃত্যু পর্যন্ত। তবে সেটা শারীরিক নয়। মানসিক। সাইকোলজিক্যল গ্রোথ। এই গ্রোথের কোন নির্দিষ্ট সীমানা কিংবা লক্ষ্য নেই। এই গ্রোথ বলতে গতানুগতিক বড় হওয়া বোঝায় না। এটা হল রিয়্যালিটির জটিলতাকে এক্সপেরিয়েন্স আর অবজার্ভ করার ওপেননেস আর ফ্লেক্সিবিলিটি অর্জন করা। কিন্তু, এই গ্রোথের সম্ভাবনা সকল মনুষ্য সাইকোলজিতে নিহিত থাকলেও সবার মস্তিষ্ক এই গ্রোথে অংশগ্রহণ করে না। অর্থাৎ, সকল মানুষের শরীর যেমন বায়োলজির ডিটারমিনেট গ্রোথের প্রক্রিয়ায় একটা নির্দিষ্ট অবস্থায় গিয়ে থেমে যায়, তেমনি বেশিরভাগ মানুষের মনও কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস, ধারণা আর চিন্তার গণ্ডিতে গিয়ে থেমে যায়। এটা হিউম্যান সাইকোলজির একটা অদ্ভুত ক্ষমতা। ওপেন-এন্ডেড একটা স্ট্রাকচার নিয়েও অগণিত মানুষের মন ক্লোজ-এন্ডেড একটা রূপ ধারণ করে পুরো জীবন পার করে দিতে পারে। এটা কীভাবে সম্ভব?

মানুষের দেহে একটা ফিজিওলোজিক্যাল ইমিউন সিস্টেম আছে। এই সিস্টেমটা অটোম্যাটিক। আপনার ফিজিওলোজিক্যাল ইমিউন সিস্টেম আপনার নির্দেশনা ছাড়াই আপনার দেহকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আপনার শরীরে যত আভ্যন্তরীণ কিংবা বহিরাগত হুমকি প্রবেশ করে, আপনার ইমিউন সিস্টেম সেগুলোকে প্রতিরোধ করে। যেমন, আপনার হাত কেটে রক্ত ঝরা শুরু হলে রক্তের প্লাটিলেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটা টেম্পোরারি প্লাগ তৈরি করে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। ইমিউন সিস্টেমের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল আপনার দেহকে বাঁচিয়ে রাখা, আপনাকে টিকিয়ে রাখা।

মানুষের শারীরিক ইমিউন সিস্টেমের মত, সাইকোলজিক্যাল ইমিউন সিস্টেমও আছে। যদিও মানুষের সাইকোলজি একটা ওপেন-এন্ডেড স্ট্রাকচার বহন করে, কিন্তু এই স্ট্রাকচারে একটা অটোম্যাটিক ইমিউন সিস্টেমের অস্তিত্ব আছে। মানুষের সাইকোলজিতে যত দুঃখ, যন্ত্রণা আর শোক এসে আঘাত হানে সেগুলো মোকাবিলা করার কাজ বেশিরভাগটাই সাইকলোজিক্যল ইমিউন সিস্টেমের দ্বারা ঘটে। যেমন, একজন ব্যক্তির পিতামাতা কিংবা খুব কাছের আপনজনের মৃত্যু কিংবা গভীর বিচ্ছেদের শুরুতে অনেক যন্ত্রণা অনুভূত হলেও ধীরে সময় গড়াতে গড়াতে সেটার তীব্রতা কমে আসে। এর কারণ, এখানে, ব্যাকগ্রাউন্ডে সাইকোলজিক্যাল ইমিউন সিস্টেম কাজ করতে থাকে নিরলস। (কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য আঘাত বেশি তীব্র হলে ইমিউন সেটাকে সমলাতে পারে না, তখন মানুষ আত্মহত্যায় নামে)। শারীরিক ইমিউন সিস্টেমের মত সাইকোলজিক্যল ইমিউন সিস্টেমেরও প্রাথমিক উদ্দেশ্য আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা, টিকিয়ে রাখা।

কিন্তু সাইকোলজিক্যাল ইমিউন সিস্টেমই অনেকক্ষেত্রে আমাদের সাইকোলজিক্যাল গ্রোথকে থামিয়ে দেয়। সাইকোলজিক্যাল ইমিউন সিস্টেমের প্রধান কাজ হল, রিয়্যালিটির প্রতিটা বিষয়, জীবনের প্রতিটা যন্ত্রণা, আঘাত, অসহনীয়তাকে সহনীয় করার জন্যে কিছু ইল্যুশন তৈরি করা, যা মানুষকে তার প্রতিদিনের জীবনের মুখোমুখি হওয়ার শক্তির যোগান দেয়। এই কাজটা করতে গিয়ে হিউম্যান সাইকোলজি কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস আর প্রত্যাশা পুরো জীবনের জন্য ফিক্স করে ফেলে, যাতে করে যখনই ভয়, যন্ত্রণা, আর অর্থহীনতা এসে আঘাত করে, তখনই যেন সেটাকে ধরাশায়ী করে নিজেকে টিকিয়ে রাখা যায়। আর সেখানেই থেমে যায় মানুষের সাইকোলজিক্যাল গ্রোথ। 

[০২-১১-২০২৩]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *