প্রাণ কী? প্রাণের ধর্ম কী? সাধারণ সংজ্ঞায়, প্রাণ হল এমন একটি অবস্থা, যা একটি জীবকে জড় পদার্থ (প্রাণহীন) ও মৃত অবস্থা থেকে পৃথক করে। অর্থাৎ, যে-কোন জড় বস্তু কিংবা অবয়বে যখন প্রাণের সঞ্চার হয়, তখন সেটা নড়াচড়া করে, খায়, ঘুমায় আর অনুভূতি বহন করে, যেখানে জড় বস্তু এর কোনটাই করে না। প্রাণের সঞ্চার ঘটে কীভাবে? আপনি যদি ধোঁয়া উঠা এক বাটি গরম ভাত আপনার রান্নাঘরে রেখে দেন, কিছু সময় পর সেটা ঠাণ্ডা হবে। সেটাকে না খেয়ে যদি একই অবস্থায় আরও সপ্তাহ খানেক রেখে দেন, তাহলে সেটাতে পচন ধরবে, দুর্গন্ধ ছড়াবে। সাথে আরও একটা অলৌকিক ঘটনা ঘটবে। আপনি দেখতে পাবেন সেই পচা ভাতগুলোর মধ্যে সাদা রঙের অনেকগুলো পোকা কিলবিল করছে। এটা দেখে আপনার গা গুলিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু কিলবিল করা এই পোকাগুলো আসলে একেকটা প্রাণ! সাধারণ অবস্থায় রেখে দেয়া মৃত ভাতের মধ্যে কোত্থেকে এতগুলো প্রাণের সঞ্চার হল? জড় বস্তু কী জীবনের জন্ম দিতে পারে? মডার্ন সাইন্স এই প্রশ্নের উত্তরে বলবে, ভাতের মধ্যে আগে থেকেই ব্যাকটেরিয়া, জীবাণুর মত মাইক্রোঅর্গানিজম সুপ্ত অবস্থায় ছিল। পচন ধরার পর ভাতের বাটিতে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে এগুলো ফ্লারিশ করার সুযোগ পেয়েছে। প্রকৃতিতে প্রায় সকল পচনশীল বস্তু থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাণ ইমার্জ করে।
এখন, আপনার রান্নাঘরে যদি আপনি এক বস্তা কনক্রিট ফেলে রাখেন, শুধু সপ্তাহ কেন, মাস পেরিয়ে গিয়ে বছর গড়ালেও সেই কনক্রিটের ভেতরে প্রাণ কিলবিল করবে না। তাহলে কি ধরে নেয়া যায় যে, সব ধরণের জড় বস্তুর মধ্যে প্রাণ সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে না? উত্তর হল, পারে। কারণ, এক বছরে না হলেও কয়েকশ’ মিলিয়ন বছর পার হলেই হয়তো পরিবর্তিত প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবে আপনার রান্নাঘরে রাখা কনক্রিটের দৈহিক অবস্থায় পরিবর্তন ঘটবে, তখন সেখান থেকেও যেকোন প্রাণ ইমার্জ করতে পারে। প্রাণের জন্য শুধু দরকার পড়ে একটা উপযুক্ত পরিবেশ। আর এই পরিবেশ চিরকালই পরিবর্তনশীল। পরিবেশের পরিবর্তিত অবস্থায় তৈরি হয় প্রাণের বৈচিত্র্য।
আপাতদৃষ্টিতে, জড় আর প্রাণ দুইটা স্বতন্ত্রভাবে বিপরীত অবস্থা হলেও কোনটাই চিরস্থায়ী নয়, সুতরাং জড় আর প্রাণ দুটোই অবিচ্ছিন্ন। ব্যাপারটা অলৌকিক না হলেও বড্ড রহস্যময়। কেন প্রাণ আসলো? এই এক্সিস্টেনশিয়াল প্রশ্নের উত্তর আমরা সঠিক জানি না। তবে কীভাবে প্রাণ বিবর্তিত হলো এবং হচ্ছে সেটার ব্যাখ্যায় আমরা নামতে পারি বৈজ্ঞানিক উপায়ে। আমরা যেহেতু মানুষ এবং আমাদের মধ্যেও যেহেতু প্রাণ স্পন্দিত হচ্ছে, তাই প্রাণের বিবর্তন বুঝতে আমাদেরকে কোন না কোন একটা গল্পের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়। কারণ, মনুষ্য সাইকোলজি গল্প ছাড়া কোন রহস্যকে ব্যাখ্যায় তুলে আনতে পারে না। এই গল্পের যোগান আসতে পারে ধর্ম থেকে, মিথোলজি থেকে কিংবা বিজ্ঞান থেকে। আমরা যে গল্প ধরে এগোই না কেন, গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা আসলে নির্ভর করে বর্তমানের পর্যবেক্ষণের উপরে। অর্থাৎ, আপনি নিজের ভেতরে প্রাণের স্পন্দন নিয়ে, নিজের উপর এবং আপনার পারিপার্শ্বিকতায় প্রাণের ধর্ম কীরূপ তা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই বুঝতে পারবেন কোন গল্পটা ক্রেডিবল আর কোনটা নয়।
বর্তমানকে পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে আমাদের ইন্দ্রিয়গত অনুধাবনের পাশাপাশি মডার্ন সাইন্সের মাধ্যমে আমরা হাতে পেয়েছি জীবাশ্ম ধরে ডাটা বিশ্লেষণ করে প্রাণের ইতিহাস ট্র্যাক ব্যাক করার টেকনোলোজি। এই টেকনোলজির উপর ভিত্তি করে প্রাণের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে স্টিভেন স্পেইলবার্গের ডকুমেন্টারি “লাইফ অন আওয়ার প্ল্যানেট (২০২৩)”।
মরগান ফ্রিম্যানের ন্যারেশনে ভিজুয়ালি স্টানিং এই ডকুসিরিজে উঠে এসেছে প্রাণের গল্প। আমাদের ভেতরে এই মুহূর্তে যে প্রাণ স্পন্দিত হচ্ছে তার গল্প। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কি শুধু একটা একক প্রাণই নিজেকে শত বাঁধা বিপত্তি আর দুর্যোগের মধ্য দিয়ে নিজেকে নানান ফর্মে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে? প্রাণকে কি আমরা একটা একক ইগো হিসেবে বিবেচনায় আনতে পারি, যেমন প্রকৃতিবাদীরা প্রকৃতিকে একটা ইগো হিসেবে ‘মাদার ন্যাচার’ বলে ডাকে? হয়তো পারি অথবা পারি না।
ডকুসিরিজে প্রাণের গল্পে দেখা যায়, পৃথিবীতে একাধিকবার মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগে শতকরা নিরানব্বই ভাগ প্রাণবৈচিত্র্যের বিলুপ্তি ঘটলেও বারবার কোন না কোন রূপে প্রাণ ফ্লারিশ করেছে।
প্রাণের বিলিয়ন বছরের এই মেগা জার্নিতে আমরা মানুষেরা এখন মাথার খুলির ভেতরে বহন করছি এক উন্নত মস্তিষ্ক। বিবর্তনের ধারায়, এই মস্তিষ্কে উদয় হয়েছে সহমর্মিতা, নৈতিকতা আর প্রাণের রহস্য না বুঝতে পেরে গল্প খোঁজার যন্ত্রণা। পরিবেশ, জিন আর চিন্তার পার্থক্যে মানুষের মস্তিষ্কেও দেখা দিয়েছে বৈচিত্র্য। যারা ধার্মিক তারা একটা গ্রেটার পারপাসে শ্রেষ্ঠত্বের দাবীতে কেয়ামত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে চান মানব প্রজাতির ডিএনএ; যারা নিরামিষভোজী তারা প্রাণীর দুঃখ অনুভব করে ভক্ষন করতে চান না কোন প্রাণীর দেহ; যারা এন্টিনাটালিস্ট তারা প্রাণের যন্ত্রণার সমাপ্তি ঘটাতে বন্ধ করে দিতে চান নতুন মানুষের জন্ম; আবার যারা স্রেফ মানবতাবাদী কিংবা পরিবেশবাদী তারা ভয়ে আছেন অতি শীঘ্রই হয়তো মানুষের হাতেই ঘটবে পৃথিবীতে প্রাণবৈচিত্র্যের পরবর্তী এক্সটিংশন, হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে মানব প্রজাতি। কিন্তু প্রাণ নিজে খুব সম্ভবত কোন মনুষ্যদলের নৈতিকতার ভিত্তিতে চলে না, চলে না কোন মনুষ্যদলের দুশ্চিন্তার ভিত্তিতেও। কারণ, প্রাণের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, যখন যাই ঘটুক না কেন, লাইফ হ্যাজ অলওয়েজ ফাউন্ড ইটস ওয়ে।