দ্যা কিলার

এমপ্যাথি। মানুষের একটা ইভ্যুলুশনারি চারিত্রিক গুণ। মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে এমপ্যাথির উপস্থিতি দেখা যায়। এটা নিজেকে অন্যের জায়গায় দাঁড় করিয়ে অন্যকে দেখার, অনুভব করার গুণ। এটা হতে পারে দুঃখে কিংবা সুখে। মানুষসহ সকল প্রাণীকুল মূলত সেলফিশ। জেনেটিক্যালি একটা প্রাণীর প্রধান প্রকৃতি হলো নিজেকে বাঁচানো। কিন্তু রিয়্যালিটি এমন যে, এখানে নিজেকে বাঁচাতে হলে অন্যের সাথে সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করা লাগে, অন্যকে বোঝা লাগে, অনুভব করা লাগে। নয়তো ঠিকঠাক বাঁচা যায় না। তাই ইভ্যুলুশনে এমপ্যাথি হয়ে উঠেছে মানুষের সেকেন্ড ন্যাচার। তবে ফিলোসফিক্যালি, সহমর্মিতা আর মায়া এক জিনিস নয়। মায়া অথবা টান হলো এক ধরনের এটাচমেন্ট। এটা সাধারণত রক্ত-সম্পর্ক কিংবা কাছের মানুষের জন্য তৈরি হয়। মায়ার ক্ষেত্রে নিজেকে অন্যের জায়গায় দাঁড় করানো লাগে না। কারণ, কাছের মানুষ কিংবা আপনজন হলো আপনারই এক্সটেন্ডেড সেলফ। তাই আপন কারও দুঃখে কিংবা সুখে আপনার মন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নিজের সেলফিশ বৈশিষ্ট্য থেকে অনুভূতিশীল হয়ে উঠে।

মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে এমপ্যাথির মাত্রায় অনেক রকমফের আছে। মানুষ বেশীরভাগ সময়ে মায়া অথবা টানের অনুভূতি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। কারণ, এমপ্যাথেটিক হওয়ার চেয়ে মায়ায় অনুভূতিপ্রবণ হয়ে উঠা সহজ, যেহেতু সেলফিশনেস মানুষের প্রধান ন্যাচার। তবে একদম ব্যাসিক সারভাইভাল ইস্যুতে সব মানুষই অন্যান্য প্রাণীদের মত মোটামুটি সমভাবে সহমর্মিতা বহন করে। মাত্রার তারতম্য সৃষ্টি হয় এর পর থেকে। মানুষের মধ্যে কে কতটুকু সহমর্মী হবে সেটা প্রথমত ইন্ডিভিজুয়াল জেনেটিক ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল। জেনেটিক প্রবণতায় কোন কোন মানুষ জন্ম থেকেই বোধহীন তথা এপ্যাথেটিক হতে পারে। অনেক বাচ্চাকে দেখা যায়, সে প্রকৃতিগতভাবেই নিষ্ঠুর। পারিবারিক সুশিক্ষা থাকা সত্ত্বেও অনেক বাচ্চা অন্য বাচ্চাকে বুলি করে, পশুপাখির উপর অত্যাচার করে, আচরণে প্রচণ্ড বদমেজাজ আর হিংস্রতা প্রদর্শন করে। বড় হয়ে সে হয়ে উঠতে পারে সিরিয়াল কিলার কিংবা স্যাডিস্ট ভায়োলেন্ট। এই ফ্যাক্টরের পরে মানুষ কতটুকু সহমর্মী হবে সেটা নির্ভর করে তার চিন্তার প্রবাহ আর আদর্শগত বন্দিত্বের উপরে।

টিপিক্যাল কিছু দুঃখ ছাড়া সকল পার্সপেক্টিভে অন্যের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখতে গেলে নিজের চিন্তার বাউন্ডারি যতদূর পর্যন্ত ভাঙতে হয় সেটা মনুষ্যমনের জন্য বেশীরভাগ সময়ই ভীতিকর। মানুষের কালচার, রিলিজিওন, এথনিসিটি আর পলিটিক্যাল ভিউ তার সহমর্মিতার মাত্রায় ভূমিকা রাখে। যখন একটা মানুষের চিন্তা একটা নির্দিষ্ট আদর্শে আবদ্ধ থাকে, যখন একটা মানুষ একটা নির্দিষ্ট মতবাদকে ডিফেন্ড করার স্পৃহা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন তার পক্ষে যথেষ্ট সহমর্মী হয়ে উঠা সম্ভব হয় না। এটা তখন বিভিন্ন বাউন্ডারিতে গিয়ে আটকা পড়ে যায়। সারভাইভালের ক্ষেত্রে অবশ্য এতবেশি সহমর্মী হওয়ার প্রয়োজন নেই। সবাই নিজের আর নিজ নিজ কালচার, এথনিক গ্রুপের প্রতি অনুভূতিশীল হলেই মানুষ প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকতে পারে। এই জায়গায় নিজের সেলফিশ প্রয়োজনে অবশ্য অন্য কালচার আর এথনিক গ্রুপের প্রতিও সহমর্মী হওয়ার কথা বলা হয়। ক্যাপিটালিজমের জনক এডাম স্মিথের মত মানুষ, যিনি মনুষ্য অর্থনীতির লাইফব্লাড হিসেবে সেলফ-ইন্টারেস্টকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তিনিও বলেন, সেলফ-ইন্টারেস্ট আর এমপ্যাথির মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। কারণ, অন্যের আবেগ আর পরিস্থিতি বুঝলে সর্বোপরি নিজেরই লাভ।

ডেভিড ফিঞ্চারের নয়া স্টাইলিশ থ্রিলার “দ্যা কিলার (২০২৩)”-এর প্রধান চরিত্র একজন প্রফেশনাল এসাসিন। তার কোন মোরালিটি নেই, এমপ্যাথি নেই। যে মানুষ টাকার বিনিময়ে অন্য মানুষকে খুন করে তার ভেতরে এমপ্যাথি থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। কেউ যখন জীবিকার জন্য প্রফেশন হিসেবে এসাসিনেশন বেছে নেয় এর পেছনে হয়তো একটা প্রধান কারণই কাজ করে। সেটা হল, তার জিরো এমপ্যাথি। হয়তো সে জেনেটিক্যালিই এমপ্যাথি শূন্য। আবার অন্য কারণও হতে পারে। হয়তো সে জীবনে এমন একটা কনটেক্সটে পড়েছে, যেখানে সে বাধ্য হয়ে তার ভেতরে থাকা এমপ্যাথিকে চাপা দিয়ে তার সেলফিশ ন্যাচারকে সারফেসে এনে নিজেকে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে সে ফিলোসফিক্যালি অস্তিত্ব ও মনুষ্য জীবনের অর্থহীনতাকে ধরে ফেলেছে। তাই সে এই প্রফেশনকে বেছে নিয়েছে। এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এটুকু বলা যায় যে, এরকম একটা পেশা বেছে নেয়ার পেছনের কারণ একদমই সাদাকালো হতে পারে না।

এই মুভির প্রধান চরিত্রের মনোলগ থেকে আমরা বুঝতে পারি, সেলফিশনেস মানুষের আদিম জিনগত প্রবণতা হলেও তার ইভ্যুলুশনারী চারিত্রিক গুণ এমপ্যাথিও জোরালোভাবে তার চরিত্রে গেঁথে গেছে। কারণ, তার নিজের সাথে নিজের কথোপকথনে এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব সূক্ষ্মভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সে এমপ্যাথিকে দুর্বলতা হিসেবে দেখে। তার মতে, এমপ্যাথি ইজ উইকনেস এবং প্রতিটা পদেই তাকে চিন্তা করতে হবে, এতে তার কী লাভ। পিউর সেলফিশনেস! কিন্তু এও দেখা যায়, তাকে এই কথা বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হয়। নিজেকে রিএশিউর করতে হয়। কেন? কারণ, এমপ্যাথি পদে পদেই সহজাতরূপে সামনে চলে আসে।

এমপ্যাথি আসলেই উইকনেস। এই উইকনেস থেকে ভালনারিবিলিটি আসে। কিন্তু মানুষের কাছে এটাকে এড়ানোর স্থায়ী কোন উপায় নেই। এটাকে বিউটি হিসেবে দেখা যায়। এটার উপরে এক ধরণের পবিত্রতাও আরোপ করা যায়। কিন্তু এটা ইভ্যুলুশনারী। তবে কমপ্লেক্স। মানুষের মন একই সাথে নিষ্ঠুর ও সহমর্মি হতে পারে। মায়ায় জড়াতে পারে। এবং এ-নিয়ে সারাজীবন দ্বন্দ্বেও ভুগতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *