আধুনিক মানুষকে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত করে রেখেছে যে আইডিয়া সেটা হল ‘ফ্রিডম’ তথা স্বাধীনতা তথা মুক্তি। এর মধ্যে ফ্রিডম নিয়ে বেশি বিভ্রান্তিতে ভুগছে নারীবাদ। প্রাক-আধুনিক যুগে কোন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ছিল না। ব্যক্তিকে তখন ব্যক্তি হিসেবেই দেখা হতো না। ফ্রিডম ব্যাপারটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দাঁড়ালো বিংশ শতাব্দীতে এসে। ব্যক্তি স্বাধীনতার পরে নারীবাদ তথা নারী স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ সেকেন্ড ওয়েভ আসলো ষাট থেকে আশির দশকে। নব্বই থেকে দুই হাজারে আসলো নারীবাদের থার্ড ওয়েভ। এগুলো হলো সভ্যতার নেসেসারি ইভেন্ট। রিয়্যালিটি যেমন কনভারজেন্ট এবং ডাইভারজেন্ট সাইকেলে চলে, তেমনি সভ্যতায়ও একটা নর্ম যখন মানুষের মধ্যে সাফোকেশন তৈরি করে ফেলে, তখন সেটাকে ভেঙে চুরমার করার জন্য একটা শক্তি জেগে উঠে, উঠতে হয়।
ফ্রিডমের জন্য মানুষ যুদ্ধ করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, স্বাধীন থাকার চেতনাটা মানুষের সহজাত। কিন্তু স্বাধীন থাকার চেতনাটা জন্মগতভাবে মানুষের মধ্যে যে তীব্রতায় থাকে, তার চেয়ে বেশি তীব্র বিপরীতমুখী মনুষ্য অনুভূতি হলো ‘সেন্স অব বিলন্গিংনেস”। মানুষ সহজাতভাবে কোথাও না কোথাও বিলোং করতে চায়, নিজেকে নিজের শেকড় দিয়ে চিনতে চায়, পরিচয় করাতে চায়। মানুষ সাধারণত দিশাহারা হতে চায় না। মানুষের এই দুই বিপরীতমুখী সহজাত প্রবৃত্তিকে চিহ্নিত করে আলাদাভাবে দেখতে না পারার কারণে আধুনিক মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীনতার বিভ্রান্তি।
প্রথমত, ভাষায় আমাদের বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দ রয়েছে, যেগুলো এক্সিস্টেনশিয়ালি ভুল (এক্সিস্টেনশিয়ালি ভুল বলতে আমি বোঝাচ্ছি যেসব শব্দের অর্থের কোন এক্সিস্টেনশিয়াল ইম্পলিকেশন নেই)। এর মধ্যে একটা শব্দ হলো, ফ্রি তথা মুক্ত। কোনকিছু ‘মুক্ত’ বলতে যে অর্থ দাঁড়ায় সেটা হলোঃ কোন বস্তু অথবা সত্তা অস্তিত্বশীল হয়ে ফাংশনাল হওয়ার ক্ষেত্রে সে তার পারিপার্শ্বিক কোনকিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু রিয়্যালিটিতে এমন কোন বস্তু কিংবা সত্তার কোন অস্তিত্ব নেই। প্রতিটা জিনিসই অস্তিত্বশীল থাকার জন্য কোন না কোনকিছুর উপর নির্ভরশীল। শুধুমাত্র এক সূর্যের উপর নির্ভর না করে টিকতে পারবে না গোটা একটা প্ল্যানেট, আবার সূর্যেরও টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন গ্যালাক্সির পারিপার্শ্বিকতা। সুতরাং এই মেটেরিয়াল রিয়্যালিটিতে মুক্ত অথবা স্বাধীন বলে কিছুই নেই। দ্বিতীয়ত, যদি (হাইপোথেটিক্যালি) মুক্তি বলে কিছু থেকেই থাকে, সেটাকে উপভোগ করে বেঁচে থাকার মত সাহসী মানুষের সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়। স্বাধীনতার এক্সিস্টেনশিয়াল ভয়াবহতা বোঝাতে গিয়ে অ্যামেরিকান এক্সিস্টেনশিয়াল সাইকিয়াট্রিস্ট ইরভিন ইয়েলেম বলেন, স্বাধীনতার অর্থ যখন পুরোপুরি মুক্তি, তখন এটার তাৎপর্যও ভয়ানকঃ যার অর্থ হলো, আমাদের পায়ের নিচে কোন মাটি নেই—কিছুই নেই, একটা শূন্যতা, একটা অতল গহ্বর। কিন্তু স্বাধীনতার অস্তিত্ব না থাকলেও, কোন নোঙ্গর ছাড়া টিকতে না পারলেও তো সহজাতভাবে মানুষ স্বাধীনতা চায়, এটা তাহলে কী? মানুষ আসলে স্বাধীনতা বলতে যেটা বোঝাতে চায় সেটা হলো, নোঙ্গরটা সে তার ইচ্ছামত যেখানে খুশী ফেলতে পারার ক্ষমতা চায়। এখন কেউ চাইলেই কি তার নোঙ্গর যেখানে-সেখানে ফেলতে পারে? কতটুকু পারে এর হিসেব অনেক জটিল। তবে এখানে একটা হিসেব খুবই সহজ, সেটা হলো, মানুষ একটা বস্তু কিংবা প্রাণী কিংবা সত্তা হিসেবে যে অবস্থানেই (ধনী কিংবা গরীব, নারী কিংবা পুরুষ কিংবা ট্রান্সজেন্ডার, গৃহবধূ কিংবা চাকুরীজীবী) অবস্থান করুক না কেন তাকে একটা স্ট্রাকচারের লিমিটেড কন্টেক্সটের মধ্যে কাজ করতে হয়। এটা হতে পারে রিয়্যালিটির স্ট্রাকচার, হতে পারে সামাজিক স্ট্রাকচার। এক্ষেত্রে জার্মান সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট এরিক সেলিগম্যান ফ্রম মানুষকে “ফ্রিডম ফ্রম” (নেগেটিভ ফ্রিডম) থেকে “ফ্রিডম টু” (পজিটিভ ফ্রিডম)-এর দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তার মতে, ক্যাপিটালিজম এবং ইন্ডিভিজুয়ালিজম মানুষকে যে ফ্রিডমের কথা বলছে, সেটা তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে আইসোলেশন আর এংজাইটিতে। এই এংজাইটি থেকে মানুষ আরও বেশি জড়িয়ে পড়ছে অথোরিটির সাথে। এরিক বলেন, সত্যিকারের ফ্রিডম আসতে পারে পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর সহযোগিতাপূর্ণ আচরণকে সাপোর্ট করে এমন স্ট্রাকচারকে এম্ব্রেস করার মধ্য দিয়ে।