১৮৪৮ সাল। শরতের এক ঝলমলে দিনে রুটল্যান্ড রেললাইনের ফোরম্যান ফিনিয়াস গেইজ কাজে গিয়ে একটা দুর্ঘটনার মুখে পড়েন। তার পায়ের কাছে একটা ছোট বিস্ফোরণ ঘটে এবং সাড়ে তিন ফুট লম্বা একটা লোহার রড ছুটে গিয়ে তার বাম চোয়ালের নিচ দিয়ে ঢুকে তার কপালের উপরের অংশ দিয়ে ফুঁড়ে বের হয়। এতে করে রডের আগায় লেগে বেশ খানিকটা মগজ বের হয়ে আসে। গেইজ তাৎক্ষণিক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মিনিট কয়েক পরে সহকর্মীদেরকে অবাক করে দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমাকে আপনারা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন না? গাড়ি ডাকতে হবে না, আমি হেঁটেই যেতে পারবো।’ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে ডাক্তার তার ক্ষত জায়গাটা মুছে দেন আর তার সহকর্মীরা মুছে দেন রডে লেগে থাকা মগজগুলো। রড খুলে ফেলার পর অল্প সময়ের মধ্যেই গেইজ তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান। এই ঘটনার পরে গেইজ আরও এক যুগ বেঁচেছিলেন। এই ঘটনায় তার শারীরিক কোন সমস্যা হয়নি। কথা বলা, কাজ করা, চোখে দেখা, ঘুরে বেড়ানো সবই ছিলো স্বাভাবিক। শুধুমাত্র যেটা বদলে গিয়েছিলো সেটা হল তার পারসোনালিটি। এরকম একটা মারাত্মক ঘটনার পরেও—যেখানে তার মাথার সামনের অংশের অনেকটা মগজ বেরিয়ে গেছে—সে কীভাবে সুস্থভাবে জীবন যাপন করছে সেটা দেখে নিউরোলজিস্টরা বেশ অবাক বনে গিয়েছিলেন। এরপর থেকে ফিনিয়াস গেইজ হয়ে উঠেন নিউরোসাইন্সের ইতিহাসে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়। বর্তমানে গেইজের মাথার খুলি রাখা আছে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলে।
মানুষের মস্তিষ্কের সামনের অংশটাকে বলা হয় ‘ফ্রন্টাল লোব’। এত বড় ফ্রন্টাল লোব মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না। মানুষের এই ফ্রন্টাল লোব কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে বিবর্তিত হয়েছে এবং এটাই মস্তিষ্কের লেটেস্ট পার্ট। মস্তিষ্কের এই অংশ দিয়েই মানুষ চিন্তা করে, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে। যে-কোন পরিকল্পনার সাথেই ভবিষ্যৎ জড়িত আর যখন ভবিষ্যতের কথা আসে, তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসে উদ্বিগ্নতা অনুভব করার ব্যাপারটা। অর্থাৎ পরিকল্পনা তথা প্ল্যানিং এর সাথে আসে উদ্বিগ্নতা তথা এংজাইটি। সেখান থেকে আসে ভয়। অন্যকথায়, মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব থেকে মানুষ দুটো বিপরীতমুখী চরিত্র পেয়েছেঃ এক, বুদ্ধিমত্তার সাথে চিন্তা, পরিকল্পনা আর ক্রিটিক্যাল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা; দুই, দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, ভয়, আর ডিপ্রেশনে ভোগার ক্ষমতা।
ফিনিয়াস গেইজের ফ্রন্টাল লোবের অনেকটা অংশ বেরিয়ে গেলেও পরবর্তীতে তার সুস্থভাবে বেঁচে থাকা থেকে বোঝা গেল যে মানুষ তার ফ্রন্টাল লোব ছাড়াও বাঁচতে পারে। গেইজ ছাড়াও পরে আরও অনেক রুগীকে দেখা গেছে ফ্রন্টাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও তারা বেঁচে থাকতে পারছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যেটা ঘটে সেটা হল, ফ্রন্টাল লোব ড্যামেজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন চিন্তা করতে পারেন না, পরিকল্পনা করতে পারেন না, কোন ক্রিটিক্যাল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না। এবং অপরদিকে, তারা কোন প্রকারের দুশ্চিন্তায়ও ভুগতে পারেন না, জীবন কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন প্রকারের উদ্বিগ্নতাও তাদের মধ্যে কাজ করে না। তারা বর্তমানে আটকে থাকেন। বর্তমানের সবকিছুই তারা ঠিকঠাকভাবে করতে পারেন এবং জীবনকেও তারা উপভোগ করতে পারেন ঠিকঠাক। গত কয়েক হাজার বছর ধরে প্রাচ্যের গুরু-ঋষিরা সাধনা করে আসছেন শুধুমাত্র নিজের মনকে ভবিষ্যৎ নিয়ে করা দুশ্চিন্তা আর ভয় থেকে মুক্ত করতে। কিন্তু মনের কাজই তো হল ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা, এই কাজ থেকে মনকে বিমুখ করা সম্ভব নয়। এটা বুঝে ফেলার পর সাধকরা পুরো মন জিনিসটা থেকেই নিজেকে মুক্ত করার সাধনা করেছেন। ষাটের দশকে হার্ভার্ডের সাইকোলজির প্রফেসর ভারতে এসে এক গুরুর কাছে সাধনা করে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে ‘বি হেয়ার নাও’ নামে এক জনপ্রিয় বই লেখেন, যেটার মূল ভাষ্য হল, জীবনে পূর্ণতা আর সুখ পেতে হলে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা বাদ দিতে হবে। একই ভাষ্য নিয়ে বই লিখে আরও জনপ্রিয় হন বর্তমান জার্মান গুরু একার্ট টোলে, বইয়ের নাম ‘দ্যা পাওয়ার অব নাও।’ বর্তমানে থাকার এই চর্চা এখন ছড়িয়ে পড়েছে পুরো বিশ্বে, দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ধ্যান—মেডিটেশন। সব মানুষই একটু সুখ চায়, নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চায়। কিন্তু একই সাথে মানুষ আবার চিন্তাও করতে চায়, নিজের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার জন্য কাজ করতে চায়। দুটো কি একসাথে পাওয়া সম্ভব? খুব সম্ভবত না। অন্তত মস্তিষ্কের ফাংশন অনুযায়ী না। তবে হয়তো আমাদের বুদ্ধিমত্তা আমাদেরকে আমাদের মেটাকগনিশনের মধ্য দিয়ে এমন একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে যেখানে দুটোর সহবস্থান হবে অনেকটা হারমোনিয়াস।