আজ থেকে দুই হাজার বছর আগে একজন রাজা তার জীবদ্দশায় যে পরিমাণ আরাম-আয়েস আর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতো বর্তমানে একজন ছাপোষা কেরানীও তার থেকে শতগুণ বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষে এখন একজন কেরানী যোগাযোগ, যাতায়াত, আর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে যে গতি এবং কনভেনিয়েন্স পাচ্ছে, দুই হাজার বছর আগে একজন রাজা সেটা স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারতো না। আপনি যদি আপনার সাধারণ জীবন নিয়ে হতাশায় ভুগে থাকেন, তাহলে এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে আপনার হতাশায় জল ঢালতে পারেন। এই জলে আপনার হতাশা তাৎক্ষণিক নিভেও যেতে পারে, আপনার মধ্যে একটা ভালোলাগা কাজ করা শুরু করে দিতে পারে। কিন্তু এই ভালোলাগা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই উবে যাবে। কারণ, মানুষ মূলত বাঁচে তুলনামূলক বিচারে (কমপারিজন)। দুই হাজার বছর আগে বাহ্যিক সুযোগ-সুবিধা যত কমই পাক না কেন, একজন রাজা ক্ষমতায় এবং অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতায় রাজাই ছিল, আর এখন আপনি আপনার হাতের স্পর্শকাতর মোবাইল ফোনে এক মুহূর্তে পুরো পৃথিবী দেখে ফেলতে পারলেও আপনি সাধারণ জনগণেরই একজন মাত্র। বাহিরের ঝলক, ঘটনা-দুর্ঘটনা মানুষের অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতার আকৃতিতে বড় স্কেলে প্রভাব ফেলতে পারলেও, মানুষ পুরোটা বাহিরের সলিড ওয়ার্ল্ডে বাস করে না। মানুষ বাস করে তার নিজের ভেতরের জগতে। প্রত্যেকটা মানুষের নিজের জগত তৈরি হয় তার ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং জিনগত প্রবণতা থেকে উদ্ভূত কিছু বিমূর্ত ধারণা নিয়ে। এগুলোর মিশ্রণই হল মনুষ্য সাবজেক্টিভিটি। তাই কে কোন সময়ে, কোন অবস্থানে, কতটা কনভেনিয়েন্স নিয়ে জীবনকে যাপন করলো এবং সেটা তার কাছে কতটুকু উপভোগ্য হলো তা নির্ভর করবে ব্যক্তির পারিপার্শ্বিকতার তুলনামূলক বিচারের উপর।
এই তুলনামূলক বিচার থেকে উদ্ভূত অনুভূতি আবার মানুষের মধ্যে একটা ইকুয়ালাইজার হিসেবে কাজ করে। ব্যাপারটা একটু ট্রিকি! যেহেতু তুলনামূলক বিচারে একজন প্রাচীন রাজার চেয়ে শতগুণ বেশি কনভেনিয়েন্স ভোগ করেও আপনি আম জনতার বাইরে যেতে না পারার যন্ত্রণা থেকে বের হতে পারছেন না, সেহেতু আপনার মনে হতে পারে যে, ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থানে যে মানুষটা নিচের দিকে থাকবে সেই শুধুমাত্র যন্ত্রণা ভোগ করবে। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। যে ব্যক্তি উপরের দিকে থাকে—অর্থাৎ রাজা—সেও যন্ত্রণা ভোগ করবে তার পারিপার্শ্বিকতার তুলনামূলক বিচারে। একজন রাজা হয়তো অন্য কোন দেশের রাজার সাথে নিজের দীনতাকে তুলনা করে যন্ত্রণা ভোগ করবে অথবা অনেক ক্ষমতাশালী হয়েও নিজের পুত্রের অকাল মৃত্যু আটকাতে না পেরে যন্ত্রণা ভোগ করবে অথবা বহুসংখ্যক নারীকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েও মনের মত একজনকেও না পাওয়ার যন্ত্রণা ভোগ করবে অথবা কোন ক্ষমতা দিয়েই নিজের মৃত্যুকে ঠেকানোর কোন পথ খুঁজে না পাওয়ার অসহায়ত্বের যন্ত্রণা ভোগ করবে। এখন, যন্ত্রণার অভ্যন্তরীণ স্কেলে—ভোগকৃত যন্ত্রণার তীব্রতায় একজন রাজা আর একজন সাধারণ মানুষের ভেতরগত কোন তফাৎ নেই। এজন্যই তুলনামূলক বিচার হলো একটা ইকুয়ালাইজার। এবার এটাকে ভেবেও আপনি মানসিক শান্তি পাওয়া শুরু করতে পারেন। কিন্তু মনুষ্যমন এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে, সে সবসময় তার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, আর অন্যান্যদের তুলনামূলক বিচারে নিজেকে কম প্রিভিলাইজ্ড হিসেবেই আবিস্কার করবে আর যন্ত্রণা ভোগ করবে, সেটা হোক রাজা কিংবা প্রজা। সুতরাং এই চিন্তা থেকেও আপনার দীর্ঘস্থায়ী মানসিক শান্তি না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে কেবল সুখ কিংবা প্রশান্তির ক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচার ইকুয়ালাইজার হিসেবে খুব একটা কাজ না করলেও সুখ আর যন্ত্রণার মিশ্রণ এবং অনুভূতির তীব্রতার মাত্রায় সবাই কোন না কোনভাবে সমান। কিন্তু এই সমতা বৈপ্লবিকদের স্বপ্ন দেখে যাওয়া সমতা নয়—এটা বরং এক্সিসটেনশিয়াল।