মানুষ আর অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে ব্যাসিক শারীরিক ম্যাকানিজমে তেমন কোন পার্থক্য নেই। শিম্পাঞ্জী আর মানুষের মধ্যে জিনগত পার্থক্য মাত্র ১%। তবুও মানুষ অন্য যে-কোন প্রাণীদের থেকে পাওয়ারফুল। মানুষের সফিসটিকেশন অন্য পর্যায়ের। এটা থেকে মানুষের মধ্যে একটা গ্র্যান্ড ধারণার জন্ম নিয়েছে যে, মানুষই শ্রেষ্ঠ। এটাকে বলা হয় এন্থ্রোপোসেন্ট্রিক চিন্তা। অন্য প্রাণীদের সাথে এত মিল থাকার পরও মানুষ ঠিক কোন কারণে এত পাওয়ারফুল সেটা নিয়ে কয়েক ধরণের মত রয়েছে। বড় ধর্মগুলোর মতে মানুষ শ্রেষ্ঠ তার আত্মার কারণে—উন্নত আত্মা—যেটা থেকে কনসাইন্সকে রেফার করে তার কর্মের জবাবদিহিতাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায়। সেক্যুলার চিন্তা দ্বারা তাড়িত মানুষরা আত্মা ছাড়াও মানুষের বিবেককে স্বীকৃতি দেন, ভালো-মন্দের তফাৎ করার ক্ষমতাই এক্ষেত্রে মানুষকে উচ্চস্থানে বসিয়ে রাখার কারণ। দেকার্তের মত দার্শনিকরা মানুষের চিন্তাকে প্রাধান্য দেন, অনেক দার্শনিকরা মনে করেন যে মানুষ স্রেফ চিন্তা করতে পারে সেটাই তাকে শক্তিশালী অবস্থানে তুলে এনেছে।
মানুষকে অন্যান্য প্রাণীদের থেকে পার্থক্যকরণের মতগুলোর মধ্যে একটা ইন্টারেস্টিং মত দিয়েছিলেন স্কটিশ অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক এডাম স্মিথ। তার মতে, মানুষও এনিমেল, তবে অন্যদের থেকে তার পার্থক্যটা হল সে বারগেইন করতে পারে। একটা মানুষ আরেকটা মানুষের সাথে সমঝোতায় যেতে পারে। সম্পূর্ণ বিপরীত ইন্টারেস্টের একটা মানুষ আরেকটা মানুষের সাথে কিছু একটা বিনিময় করে সহবস্থান করতে পারে। তিনি বলেন, মানুষ আংশিক দয়ালু আর আংশিক স্বার্থপর। তবে মানুষের স্বার্থপরতার অংশটাই বড়। সেলফ-ইন্টারেস্টই মানুষের মূল বিহেভিয়ারকে চালিত করে। অন্যান্য প্রাণীরা মানুষের মত করে নিজের স্বার্থটাকে এত ভালো বোঝে না। এর মানে এই নয় যে অন্যান্য প্রাণীরা স্বার্থহীন। ওরা নিজের ক্ষুধা মেটানোর জন্য অন্যের উপর হামলা ঠিকই করে। তবে এরা মানুষের মত বারগেইন করতে পারে না। এক কুকুর অন্য এক কুকুরের সাথে হাড্ডি বিনিময় করে না।
মানুষ তার সেলফ-ইন্টারেস্টের বৈশিষ্ট্য থেকেই সহযোগিতাপূর্ণ আচরণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। মানুষ বুঝে ফেলেছে যে, আমি যেটা অন্যের কাছ থেকে চাই সেটা পাওয়ার একমাত্র পন্থা হল বিনিময়ে তাকে কিছু একটা দেয়া। মানুষ মানবতা বলতে আসলে এটাকেই বুঝায়। মানুষ যেটা করে সেটা আসলে ‘মানবতা’ নয়, এটা হল সেলফ-লাভ। এটা থেকেই এসেছে পণ্য বিনিময় আর ট্রেডিং, যেটা পরবর্তীতে বৈপ্লবিক রূপ ধারণ করেছে টাকা আবিস্কারের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু মানুষের এই ম্যাজিক্যাল ইন্টেলিজেন্স আর তার সেলফ-ইন্টারেস্ট এর প্রসূত এতসব জৌলুসের আড়ালে তার জন্য অটোম্যাটিক্যালি তৈরি হয়ে গেছে একটা সাইকোলজিক্যাল ট্র্যাপ। এটার পেছনে কারও ইন্টেনশনাল কন্সপিরেসি আছে ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটেছে। টেকনোজিক্যালি দিন দিন দ্রুত থেকে দ্রুততরভাবে উন্নত হতে থাকলেও মানুষ তার সাইকোলজিক্যাল এংজাইটি, ইনসিকিউরিটি, প্যানিক আর ফিয়ারে আগের থেকে আরও বেশি ভঙ্গুর হয়ে উঠেছে। এমন কেন হয়েছে আমরা তা সঠিক জানি না। অনেক ধরনের ন্যারেটিভ অবশ্য তৈরি করা যায় এক্ষেত্রে। মানুষের সাইকোলজিক্যাল এই ভঙ্গুরতাকে দূর করার জন্যে এখন পর্যন্ত আমরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে যেসব ড্রাগ তৈরি করেছি সেগুলো এখনও এই সমস্যা সমাধানের ধারে কাছেও যেতে পারছে না। এর বিকল্প হিসেবে পশ্চিমারা পূর্বাঞ্চলের আধ্যাত্মিকতাকে ইম্পোর্ট করা শুরু করেছে। কিন্তু এদিকে আধ্যাত্মিকতার জন্মদাতা পূর্বাঞ্চলের লোকজনও নিজেদেরকে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আবিস্কার করছে নর্দমায়। তারা আবার প্রাণপণে ছুটে যেতে চাচ্ছে পশ্চিমের দিকে। আর এই দুইয়ের মাঝে এখনও যে পন্থাটা মানুষের স্যানিটিকে আপাতভাবে ধরে রেখেছে সেটা হল মাইন্ডলেস গ্রোথ। মাল্টিপ্লাই, মাল্টিপ্লাই! এক্ষেত্রে অ্যামেরিকান লেখক এডওয়ার্ড এবি বলেছিলেন, “গ্রোথ ফর দ্যা সেইক অব গ্রোথ ইজ দ্যা আইডিওলোজি অফ অ্যা ক্যান্সার সেল।”