মৃত্যুর ব্যক্তিরূপ

সাহিত্যে পারসোনিফিকেশন বলে একটা কথা আছে। কোন বস্তু কিংবা বিমূর্ত ব্যাপারকে ব্যক্তিরূপ দান করে তাকে একটা চরিত্র হিসেবে গল্পে তুলে ধরাকে পারসোনিফিকেশন বলা হয়। এযাবতকালে, মিথলোজি, শিল্প, সাহিত্য আর পপ কালচারে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং যে বিমূর্ত ব্যাপারটাকে পারসোনিফাইড করা হয়েছে সেটা হল মৃত্যু। ১৯৫৭ সালে সুইডিশ পরিচালক ইংমার বার্গম্যান পরিচালিত সিনেমা ‘দ্যা সেভেন্থ সিল’ মৃত্যুকে পারসোনিফাই করার এক ক্লাসিক উদাহরণ। এই সিনেমায় দেখা যায়, মূল চরিত্র স্বয়ং মৃত্যুর সাথে বসে দাবা খেলে। এই খেলা দিয়ে সে নিজেকে বাঁচাতে কিংবা মৃত্যুকে বিলম্বিত করতে চায়। অ্যামেরিকান পরিচালক উডি এলেন নির্মিত ‘লাভ এন্ড ডেথ’-এও মৃত্যুকে একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখা যায়। গ্রিক মিথলোজিতে ‘গ্রিম রিপার’ নামেও দেখা যায় মৃত্যুকে।

মৃত্যুর এত এত পারসোনিফিকেশন দেখা গেলেও জীবনের পারসোনিফিকেশন দেখা যায় না কোথাও। মৃত্যু কী? সাধারণত, মৃত্যুকে আমরা দেখি জীবনের একটা বিপরীত শক্তি হিসেবে, যে শক্তিতে জীবনের অবসান ঘটে। মৃত্যু মনুষ্যমনের কাছে একটা বিমূর্ত ব্যাপার। বিমূর্ত হলেও এটা এত স্পষ্ট আর অনাকাঙ্ক্ষিত যে, এটাকে একটা ব্যক্তিরূপ দেয়া যায়। মানুষ যে-কোন বিমূর্ত শক্তিকে কনসেপচুয়ালাইজ করার ক্ষেত্রে সেটাকে নিজের অবয়বের কাছাকাছি কিছু হিসেবেই চিন্তা করে। তাই মৃত্যুকেও মানুষ মানবাকৃতির একটা অবয়ব হিসেবে কল্পনা করে নেয়। মৃত্যুকে দেখতে সাধারণত একটা সাদা কিংবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কালো আলখেল্লা পরা, হাতে ধারালো একটা অস্ত্র বহনকারী ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু জীবনকে কেন কোন ব্যক্তিরূপে দেখানো যায় না? কারণ, জীবন মৃত্যুর চাইতেও আরও বেশি বিমূর্ত। তাছাড়া, মৃত্যুর মত জীবনকে আলাদা করে দেখা যায় না। জীবনের অনেক রূপ, অনেক গঠন, আর জীবন আকাঙ্ক্ষিত, জীবন আমরা নিজেই। অন্যদিকে, মৃত্যুর একটাই রূপ—সে সবকিছুকে শেষ করে দেয়।

সকল মানুষই জানে যে জীবিতদের জন্য মৃত্যু একটা বড় সত্য। তাকে এড়ানোর কোন উপায় নেই। জীবনে প্রবেশ করলে মৃত্যু আসবেই। এটা জেনেও মানুষ জীবনকে সাবস্ক্রাইব করে। যদিও নিজের ইচ্ছায় জন্মানো যায় না, তবে জন্মের পর মানুষ জীবনকে ভালোবাসে, জীবনের প্রেমে পড়ে। সেই প্রেম থেকে সে আরও মানুষকে জন্ম দেয়। যেমন, আমার জন্মের পর আমার মা যখন প্রথমবারের মত আমাকে কোলে নিয়ে পৃথিবীর বিশুদ্ধতম আনন্দে আনন্দিত হচ্ছিলো, তখন সে এও জানতো যে, আমাকে জন্ম দিয়ে সে নিশ্চিত করলো যে আমি একদিন মারা যাব। আমার মৃত্যুর জন্য আমার বাবা-মা’ই দায়ী হবেন, যেহেতু তারা আমার জন্মের জন্য দায়ী। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও মানুষ জীবনকে সাবস্ক্রাইব কেন করে সেটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। এখানে দুটো প্রধান বিষয় হয়তো কাজ করেঃ প্রথমত, জীবন সীমিত হলেও এটা সংবেদনশীলতায় পূর্ণ। আর দ্বিতীয়টি হল, জীবনের পর মৃত্যু আসলেও মৃত্যু কাউকেই ছাড় দেয় না। কি ধনী, কি দরিদ্র, কি বলিষ্ঠ, কি দুর্বল, কি বয়স্ক, কি শিশু—বর্ণ, গোত্র, সমাজ এবং কাল নির্বিশেষে সবাইকেই একদিন মরতে হয়। সদ্য যে শিশু জন্ম নিয়ে আপনজনের মনে আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিল সে একদিন মারা যাবে, আজকে যে ব্যক্তি লটারিতে মিলিয়ন ডলার জিতে গেল সেও একদিন মারা যাবে, দুইদিন অনাহারে থাকা বস্তির ঘরের কোণে পড়ে থাকা বুড়িটাও একদিন মারা যাবে, সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রধান আসনে বসা রাষ্ট্রপতিও একদিন মারা যাবে, নতুন প্রেমের আবেগি রসে আকন্ঠ ডুবে থাকা চুম্বনরত জোড়া প্রমিক-প্রেমিকারাও একদিন মারা যাবে। ডেথ ইজ দ্যা গ্রেট ইকুয়ালাইজার। মৃত্যু একটা ভয়ানক ব্যাপার হলেও তার চমৎকার দিক হল সে সাম্যতার আল্টিমেট প্রতিষ্ঠাতা—যে সাম্য প্রতিষ্ঠার তরে অসংখ্য মানুষ সংগ্রাম করে গেছে—যে সাম্য পৃথিবীর বুকে কোনদিন প্রতিষ্ঠিত হয়তো হবেও না। কারণ, সাম্যে জীবনের শক্তি ঠিকঠাক কাজ করে না। জীবন বিচিত্র—জীবন অসম। কিন্তু সমতা মনুষ্যমনের একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা ছিল, আছে এবং হয়তো থাকবে। জগতে সমতা নেই, এটা মনুষ্যমনের জন্য খুবই হতাশার একটা ব্যাপার। বলা হয়, গ্রেট মার্কসবাদী দার্শনিক লুইস আলথুসার নাকি পৃথিবীর বুকে সাম্যতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে পাগল হয়ে গিয়ে জগতের মানুষের প্রতি ঘৃণায় আর যন্ত্রণায় তার নিজের স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিলেন। কিন্তু হায়, মৃত্যু ছাড়া কে আছে এত বিশ্বস্ত সাম্যতায়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *