জ্ঞান অর্জনের কয়েকটা স্তর রয়েছে, যদিও এসব স্তর-ফর স্রেফ মনুষ্য ব্যাপার। রিয়্যালিটিতে আসলে কোনকিছুর কোন স্তর নেই, যদি সেখানে কোন এক্সপেরিয়েন্সার না থাকে। জ্ঞান যেহেতু এখানে একটা মনুষ্য ব্যাপার আর মানুষ যেহেতু ভাষা ছাড়া কোনকিছু ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করতে পারে না, তাই এক্সপেরিয়েন্সার হিসেবে মনুষ্য সাবজেক্টিভিটি থেকে আমরা জ্ঞানকে কয়েকটা স্তরে ভাগ করতে পারি। ভাগ করার আগে বলে নেওয়া ভালো, আমরা যখন কোন টার্ম শিখি এবং সেটার ব্যবহার করি, তখন সেই টার্ম তার নিজের অর্থ প্রকাশের জন্য সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে ঠিক তার বিপরীত অর্থের আরেকটা টার্মের উপর। যেমন, কাউকে ‘জ্ঞানী’ বললে এর অর্থ হল তিনি ‘মূর্খ’ নন। অর্থাৎ যদি মূর্খতার অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে জ্ঞানী বলেও কাউকে ডাকা যেত না। যাইহোক, সাধারণভাবে সংজ্ঞায়িত করলে আমরা বুঝি যে যিনি জ্ঞানী তিনি জানেন, আর যিনি অজ্ঞ কিংবা মূর্খ তিনি জানেন না। সেই সুত্রে, একজন ব্যক্তি যত বেশি জ্ঞান অর্জন করবে তার অজ্ঞতা তত বেশি দূর হবে। এটাই সূত্র আর এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যাপারটা কি আসলেই এমন?
কোন এক কারণে মনুষ্য ইন্টেলিজেন্সে একটা অদ্ভুত প্যাটার্ন তৈরি হয়েছে। সেই প্যাটার্ন থেকেই জ্ঞানের স্তরগুলোকে ভাগ করা যায়। প্রথমত, জন্মের পর মানুষের মস্তিষ্কের শৈশাবস্থায় ইভ্যুলুশনারী ব্যাসিক ইন্সটিংক্টগুলো ছাড়া সেখানে তেমন কোন জ্ঞান থাকে না। তখন সেই মানুষটাকে আমরা শিশু বলে ডাকি। শিশু শব্দের অর্থ আসলে মূর্খই। কেবল বয়স কম হওয়ার কারণে আমরা ‘শিশু’ শব্দটা ব্যবহার করি। বয়স বেড়ে গিয়েও যখন কেউ তার মস্তিষ্কে আশানুরূপ জ্ঞান জমা করতে পারে না, তখন তাকে আমরা ‘মূর্খ’ বলে ডাকি। সুতরাং শিশু আর মূর্খ দুটো শব্দের অর্থ একই। যখন কেউ ইন্টেলিজেন্সের শৈশাবস্থা পার করে কিছু নতুন জ্ঞান জমা করে সেগুলো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা শেখে, তখন সে জ্ঞানের প্রথম স্তরে পৌঁছায়। প্রথম স্তরের জ্ঞানী ব্যক্তিদের সামনে জ্ঞান অর্জন একটা চমকিত পুলকের ব্যাপার হয়ে ধরা দেয়। সে এক চরম অস্থির সুখের মধ্যে ডুবে যায়। সে তার নিজের পূর্বের অজ্ঞতার কথা চিন্তা করে লজ্জা পায়, আবার নতুন জ্ঞানের সন্ধান পেয়ে গর্বও বোধ করে।
প্রথম স্তরের অর্জিত জ্ঞানের উপর ভর করে যখন কেউ সমাজের, সিস্টেমের, প্রথার হাজার বছরের লালিত রীতিনীতি, আইনকানুনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা শুরু করে—বুঝতে শুরু করে এসবের অসাড়তা—যখন কেউ ঐতিহ্যের সকল শৃঙ্খলকে চিহ্নিত করে ফেলে—যখন কেউ স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ পেতে আকুল হয়ে পড়ে, তখন সে জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করে। এই স্তরের জ্ঞানী ব্যক্তিদের মধ্যে একটা বিদ্রোহী চেতনা কাজ করে জোরালোভাবে এবং তাঁরা মনেপ্রাণে চায় পুরো পৃথিবীকে বদলে দিতে—সকল মানুষকে বদলে দিতে—পুরো জগতজুরে এত অজ্ঞতা আর অবিচার দেখে তাঁরা পীড়িত হয় ভীষণ।
কেউ যখন জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তরে যথেষ্ট পরিমাণ পীড়া ভোগ করে—গভীরভাবে জগতের সকল প্যাটার্নের উপর দৃষ্টিপাত করে—তখন সে সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় এবং নিরানন্দে জ্ঞানের তৃতীয় স্তরে পা রাখে। এটা এমন এক স্তর যেখানে এসে ব্যক্তি আর পৃথিবীর কোনকিছুই বদলাতে চায় না। পৃথিবীতে তার কোন পক্ষ থাকে না, বিপক্ষও থাকে না। শৃঙ্খলা আর স্বাধীনতা উভয়ই কেবল দুটো টার্ম হিসেবে ঝুলে থাকে তার নাকের ডগায়—এছাড়া এসবের আর কোন অর্থ সে খুঁজে পায় না। দিনে দিনে সে যতই জানতে থাকে, ততই বাড়তে থাকে তার অজ্ঞতা। আমাদের জীবন, পারিপার্শ্বিকতা, বস্তু, অবস্তু—সবকিছু এমন নন-লিনিয়ার আর প্যারাডক্সিক্যাল যে—এখানে জ্ঞান আর মূর্খতা একই মস্তিষ্কে পাশাপাশি অবস্থান করে অবলীলায়। এখানে কখনও মূর্খতার প্রভাবে জ্ঞানের পরিধি কমতে পারে, আবার জ্ঞানের প্রভাবে মূর্খতার পরিধি বাড়তে পারে। তাহলে জ্ঞান অর্জনের মূল্য কী? কোন মূল্য নেই। কেবল বলা যায়, জ্ঞান অর্জনকারী মূর্খদের ভেতরে এক গভীর বোধ তৈরি হয়, যা অব্যাখ্য—তৈরি হয় সংবেদনশীলতা আর নমনীয়তাঃ
আমি জানিনে কীসের লাগিয়া এই জগত উথিল—
ফুটিল প্রাণ, দুলিল শাখা, নামিল মৃত্যু;
জানিনে কোনটা উত্তরের উত্তর, পূর্বের পূর্বে রহিয়াছে কী!
তুমি জানো কি?