১৮৯৯

একদল লোক জীবনভর একটা গুহায় শিকলবন্দী হয়ে আছে। তাদের বন্দীদশাটা এমন যে তারা শুধু তাদের চোখের সামনে গুহার দেয়ালটা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। পেছন দিকে ঘুরে তাকানোরও কোন সুযোগ নেই। তাদের পেছনে রয়েছে জ্বলন্ত আগুন। আগুন আর তাদের মাঝামাঝি জায়গাটা দিয়ে অন্য মানুষরা হাতে পুতুল কিংবা অন্যান্য জিনিস নিয়ে আসা যাওয়া করে। তাদের ছায়া গিয়ে পড়ে বন্দীদের সামনের দেয়ালটার উপর। বন্দীরা এই চলমান ছায়াগুলোকে দেখে, কিন্তু এই ছায়া কীসের বিপরীতে তৈরি হয় সেটা তারা দেখতে পায় না। তাই তারা ছায়াগুলোকেই রিয়্যালিটি হিসেবে ধরে নেয়। অর্থাৎ তারা মনে করে যে, এই ছায়াগুলোই বাস্তব, এগুলোই সত্য, জগতে এর বাইরে আর কিছু নেই।

একদিন এদের মধ্য থেকে একজন বন্দী তার শিকল ছিঁড়ে ফেলতে সক্ষম হয়। সে প্রথমবারের মত দেখতে পায় তার পেছনের আগুন আর হেঁটে যাওয়া মানুষদেরকে। বুঝতে পারে এতদিন যে ছায়াগুলোকে সে রিয়্যালিটি মনে করেছে সেটা মিথ্যা। সে গুহা ছেড়ে পালায়। বাহিরে গিয়ে দেখে পুরো এক জগত পড়ে আছে যার অস্তিত্বের কথা সে এতদিন জানতোই না। সে গুহায় ফিরে আসে অন্য বন্দীদেরকে মুক্ত করার জন্যে। ফেরার পর দেখা যায় সে ইতিমধ্যে অন্ধ হয়ে গেছে, কারণ প্রথমবারের মত সূর্যের আলো পাওয়ায় তার চোখ সহ্য করতে পারেনি। তার অন্ধ হওয়া দেখে অন্য বন্দীরা আর মুক্ত হতে চায় না, কারণ তারা ধরে নেয় গুহা ছেড়ে যাওয়াটা খারাপ, এতে তারাও অন্ধ হয়ে যাবে।

এটা দার্শনিক প্লেটোর বিখ্যাত এলিগরি। এলিগরি অব দ্যা কেইভ। এটা নিয়ে প্রচলিত অনেক আলোচনার মধ্যে মূল যে প্রশ্নটা জেগে উঠে সেটা হলো, আমরাও কি গুহার বন্দীদের মত রিয়্যালিটির ভুল ভার্সনটা দেখে যাচ্ছি জীবনভর? এই রিয়্যালিটির বাহিরে কি অন্য কোন রিয়্যালিটি আছে যার অস্তিত্বের কথা আমরা জানিই না? হাজার বছরেও এই প্রশ্নের সন্তোষজনক কোন উত্তরের কাছাকাছি এখন পর্যন্ত কেউ যেতে পারেনি। তবে মানব মস্তিস্ক নিয়ে বিজ্ঞানের নাড়াচাড়া থেকে এটুকু বোঝা যায় যে, একই রিয়েলিটিকে আলাদা আলাদা ব্যক্তি আলাদাভাবে এক্সপেরিয়েন্স করে থাকে। ব্যক্তির সাবজেক্টিভিটি তার নিজের জগতকে তার নিজের মত করে তৈরি করে নেয়। তাহলে কি আমরা সবাই প্রতিদিন একই সূর্যকে দেখি না? হ্যাঁ, দেখি। যদি দেখি, তাহলে তো সূর্যটা আমাদের মস্তিষ্কের তৈরি করা রিয়্যালিটি নয়। হ্যাঁ। তবে একই সূর্যকে দেখার অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা ব্যক্তি ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়ে থাকে। সূর্যটা হয়তো ব্যক্তির দেখা বা না দেখা ছাড়াও অস্তিত্বশীল। এক্ষেত্রে বলা যায়, রিয়্যালিটি সাবজেক্টিভিটি আর অবজেক্টিভিটির একটা মিশ্রন। এটা বলা যায়, তবে নিশ্চিত করে বলা যায় না।

মানুষের নিজস্ব মতবাদ, অভিজ্ঞতা আর বিশ্বাস তার নিজের জন্য যে জগত তৈরি করে অথবা বাহ্যিক জগতকে দেখার যে দৃষ্টিভঙ্গি তার তৈরি হয়, সেখানে সেটা এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তি, এক ধর্মীয় দল থেকে আরেক ধর্মীয় দল, এক রাজনৈতিক দল থেকে আরেক রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ কিংবা বৃহদাংশে ভিন্ন হতে পারে। এটা অবশ্য নিশ্চিত করে বলা যায়। প্লেটোর গুহার বন্দীদের মত আমরাও নিজেদের সঞ্চিত জ্ঞান আর বিশ্বাসের বাইরে চোখ ফেলতে চাই না চোখ ঝলসে যাবার ভয়ে অথবা আমরা জানিও না যে আমাদের জানার বাইরেও অন্যকিছু থাকতে পারে, থাকতে পারে পুরো অন্য এক জগত।

জার্মান পরিচালক বারান বো ওডারের নির্মিত ১৮৯৯ সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিউরোলজিস্ট মোরা হেনরিয়েটও রিয়েলিটিকে নিয়ে প্লেটোর এলিগরিতে উঠে আসা প্রশ্ন দ্বারা পীড়িত হন। তার বাবার মতে, পৃথিবীতে দুই ধরণের মানুষ রয়েছেঃ একদল হলো যারা রিয়েলিটিকে জীবনভর এড়িয়ে যায়, আর আরেকদল হলো যারা জীবনভর খুঁজে বেড়ায়। যারা এড়িয়ে যায় তারা সুখী, যারা খুঁজে বেড়ায় তাদের যন্ত্রণা সীমাহীন। এহেন যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও একদল মানুষ কিছুতেই খুঁজে বেড়ানো থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না। মোরা হেনরিয়েটও পারেননি। তাই তিনি সৃষ্টি করেন সিমুলেটেড এক অল্টারনেট রিয়েলিটি, যেখানে তিনি নিজেই ভুলে যান রিয়েল রিয়েলিটির কথা, ডুবে থাকেন এক গভীর ঘুমে—যে ঘুমের জগতকে সত্য জগত হিসেবেই ভ্রম হয়।

হয়তো আমরা সবাই ঘুমিয়েই আছি—হয়তো কোন একদিন জেগে উঠে দেখবো—আমাদের নিজেদের ঠুনকো মতবাদগুলোর মতই, আমাদের ছেলেবেলার খেলনাগুলোর মতই, আমাদের সীমাবদ্ধ বিশ্বাসগুলোর মতই, আমাদের পচে যাওয়া চিন্তাগুলোর মতই—আমাদের এতদিনের দেখা, শোনা, অনুভব করা সবই ছিলো মিথ্যা। কে জানে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *