জীবন কি নয়রাথের নৌকা?

ধরুন, একদল নাবিক একটা নৌকা কিংবা জাহাজে করে পাড়ি দিচ্ছে সুদীর্ঘ জলপথ। তাদের পথ এতটাই দীর্ঘ যে, জলে থাকা অবস্থাতেই তাদেরকে ধীরে ধীরে পুনর্নির্মাণ করতে হবে নৌকাটাকে। এটা চলতি পথে জলে থাকা অবস্থাতেই করতে হবে, শুকনো জায়গায় নৌকাটাকে তুলে নিয়ে ভেঙ্গেচুরে ঠিকঠাক মেরামত করার কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে, একটা পুরনো কাঠ সরাতে চাইলে সাথে সাথে সেখানে আরেকটা নতুন কাঠ প্রতিস্থাপন করতে হবে। এভাবে একে একে সবকটা পুরনো অংশ সরিয়ে পুরো নৌকাটাকেই নতুন করে নির্মাণ করা সম্ভব। এটা একটা প্রক্রিয়া অথবা মডেল। অস্ট্রিয়ান দার্শনিক অটো নয়রাথ বিজ্ঞানকে এমন একটা প্রক্রিয়ার সাথে তুলনা করেছিলেন। তার মতে, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অর্জন এবং রূপান্তরের ক্ষেত্রে এই মডেলকে অনুসরণ করতে হবে। চলন্ত অবস্থাতেই প্রতিনিয়ত সংশোধন করতে হবে জ্ঞান। তার এই এনালজিকে সুইডিশ দার্শনিক মারটিন হ্যাগলান্ড তুলনা করেছেন মানুষের জীবনের সাথে। তিনি বলেন, নিজেকে আমি নয়রাথের নৌকাতে আবিস্কার করেছি, যে নৌকার শুরুও জলে এবং শেষও হবে জলে। এখন আমি কী হবো—কীভাবে আমার নৌকাটাকে পুনর্নির্মাণ করবো—সেটার বড় একটা অংশ নির্ভর করে আমাদের সামাজিক রীতিনীতির উপরে। কিন্তু এইসব রীতিনীতিকে ক্রমান্বয়ে চ্যালেঞ্জ করে নিজেকে ভেঙে ভেঙে নতুনভাবে গড়তে পারি নিজের কর্মের মধ্য দিয়ে। আমি নৌকার বিভিন্ন অংশ প্রয়োজন মত পরিবর্তন কিংবা প্রতিস্থাপন করতে পারি এবং যেহেতু আমি পুরো নৌকাকে একবারেই ভেঙে ফেলছি না, তাই আমি কর্ম চলাকালীন নিজেকে ভাসিয়েও রাখতে পারি জলে। মাঝেমধ্যে হয়তো আমার জীবনে বড় ধরণের সংস্কারের প্রয়োজন হতে পারে, সেটাও আমি করতে পারি, তবে এখানে একটা সততা বজায় রাখতে হবে সবসময়। আবার এমনও হতে পারে যে আমি এই নৌকার পুরোটাকেই ধ্বংস করে ফেলতে চাইছি—কিংবা আমার আর এই নৌকাকে মেরামত করার ইচ্ছা নাই—আমার ইচ্ছা ডুবে যাই। এক্ষেত্রেও আমাকে আমার সিদ্ধান্তে সততার সাথে অটল থাকতে হবে যে আমি আর আমার এই জীবন রাখতে চাই না।

এটাকে বলা হয় স্পিরিচুয়াল ফ্রিডম। কিন্তু নিজেকে আমরা ঠিক কতটুকু ভাঙতে পারি আর কতটুকু গড়তে পারি সেটার সঠিক হিসেব মেলানো যায় না। অথবা প্রশ্ন আসতে পারে, আমরা আদৌ কি নিজের ইচ্ছায় সেটা করতে পারি? সম্প্রতি বৈজ্ঞানিক স্টাডিতে দেখা যায় যে, একটা মানুষ চরিত্রগতভাবে বদমেজাজি হবে নাকি নমনীয় হবে, একগামী হবে নাকি বহুগামী হবে, শান্ত হবে নাকি উগ্র হবে সেটার শতকরা পঞ্চাশভাগ নির্ধারিত হয় তার জন্মগত জিন দ্বারা। আর বাকি যে পঞ্চাশভাগ রয়ে যায় সেখানে কাজ করে ব্যক্তির সামাজিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিকসহ আরও অনেক অনেক ফ্যাক্টর। এসবের মধ্যে ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছার চর্চার জায়গা ঠিক কতটুকু? আমরা জানি না। এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কেউ দিতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। তবে এটুকু আমরা বুঝতে পারি যে, জন্মের পর থেকেই জীবনভর চলতে থাকে আমাদের জ্ঞান, আদর্শ, বিশ্বাস এবং আমিত্বের ভাঙাগড়ার এক খেলা। আর এই ভাঙাগড়ার কাজটা কোথাও দাঁড়িয়ে করার কোন সুযোগ নেই। রাতারাতি করারও কোন সুযোগ নেই। এবং আমরা এও অনুভব করতে পারি যে, এই খেলায় কোথাও কোন একভাবে লুকিয়ে থাকে আমাদের স্বাধীনতার একটা ফাঁকা জায়গা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *