স্বাধীনতা থেকে পলায়ন

আধুনিক যুগের চক্ষু দিয়ে যদি আমরা মধ্যযুগের দিকে তাকাই, তাহলে সেটাকে স্রেফ অন্ধকার যুগ ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। কারণ, মধ্যযুগে কোন ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল না। বড় গোষ্ঠীগুলো ছোট গোষ্ঠীকে শোষণ করতো। মানুষজন কুসংস্কারচ্ছন্ন ছিল। প্রত্যকেই তার নিজ নিজ সামাজিক ভূমিকায় বন্দি ছিল। সমাজে এক শ্রেণী থেকে আরেক শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির সুযোগ প্রায় ছিল না বললেই চলে, এমনকি কোন ব্যক্তি এক শহর থেকে আরেক শহরে কিংবা এক দেশ থেকে আরেক দেশে বসবাস করার কথা প্রায় চিন্তাই করতে পারতো না। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, একজন ব্যক্তির যেখানে জন্ম হতো সেখানেই তাকে পুরো জীবন পার করে দিতে হতো। মানুষের তখন নিজের পছন্দমত পোশাক পরার স্বাধীনতা ছিল না। ছিল না নিজের পছন্দমত খাওয়ার স্বাধীনতাও। একজন কৃষক কিংবা কারিগরকে শহরের নির্ধারিত বাজারেই তার পণ্য বিক্রি করতে হতো। এক সংঘের সদস্য অন্য সংঘের সদস্যের সাথে কোন তথ্য শেয়ার করতে পারতো না। মানুষের ব্যক্তিগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবন পুরোটাই নিয়ন্ত্রিত হতো বিভিন্ন নিয়মনীতি এবং বাধ্যবাধকতা দ্বারা।

কিন্তু যদিও তখন একজন ব্যক্তি স্বাধীন ছিল না, একই সাথে কোন ব্যক্তি একাকী এবং বিচ্ছিন্নও ছিল না। মানুষ যেহেতু জন্মের পর থেকেই একটা অপরিবর্তনশীল এবং প্রশ্নাতীত সামাজিক নিয়মে আবদ্ধ হয়ে পড়তো, সেটা তাকে একটা কাঠামোগত সমগ্রের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে রাখতো, যা তার জীবনকে একটা অর্থ দিতো, যেখানে সংশয়ের অবকাশ কিংবা প্রয়োজন কোনটারই জায়গা ছিল না। একজন ব্যক্তি তার সামাজিক পেশাকেই তার নিজের পরিচয় হিসেবে বিবেচনা করতো। যেমন, একজন কৃষক, কারিগর কিংবা নাইট নিজেকে তার পেশার বাইরে আলাদা কোন ব্যক্তি হিসেবে চিন্তা করতো না। সামাজিক নিয়মকানুনকেই যেহেতু প্রাকৃতিক নিয়ম হিসেবে চিন্তা করা হতো, তাই এগুলো মানুষকে সর্বদা একটা নিরাপত্তা এবং সকলের সঙ্গে একীভূত হওয়ার একটা অনুভূতি দিত।

মানুষের তখন যন্ত্রণা এবং ভোগান্তিও ছিল অনেক বেশি। কিন্তু এই ভোগান্তিকে সহনীয় করার জন্য ছিল ধর্ম।  গির্জায় যখন বলা হতো যে, পৃথিবীর সকল ব্যক্তির ব্যক্তিগত সকল পাপ আদমের সেই আদি পাপেরই ফল, তখন মানুষের কাছে নিজের সীমাহীন যন্ত্রণাকেও সহনীয় মনে হতো। গির্জায় যদিও ব্যক্তির মধ্যে এক ধরণের ধর্মীয় অপরাধবোধ ঢুকিয়ে দেয়া হতো, পাশপাশি ঈশ্বরের ভালোবাসা আর ক্ষমাশীলতার কথাও ফলাও করে উল্লেখ করা হতো। ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্কে সংশয় আর ভয়ের চেয়ে আত্মবিশ্বাসই ছিল বেশি। মানুষ যেহেতু তার নিজের অঞ্চলের বাইরে অন্য কোথাও তেমন যেত না, তাই পুরো মহাবিশ্ব ছিল তাদের কাছে খুবই সিম্পল, যেখানে পৃথিবী আর মানুষই ছিল সবকিছুর কেন্দ্র।

আধুনিক যুগ সম্পূর্ণ অন্যরকম। মধ্যযুগের সাথে আধুনিক যুগের বড় পার্থক্যটা হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। ব্যক্তি এখানে অনেকটা স্বাধীন। অন্তত বিমূর্তভাবে হলেও ব্যক্তির একটা স্বাধীন চেতনার চর্চা করা যায় আধুনিক যুগে। মানুষ এখন নিজের ইচ্ছা চর্চা করার সুযোগ পায়। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সহজেই চলে যেতে পারে। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনও আর মধ্যযুগের মত নেই। কিন্তু এখন, এই ইন্ডিভিজুয়ালিজম তথা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের যুগে, জন্ম নিয়েছে নতুন ঝুঁকি। ব্যক্তিস্বাধীনতায় ভেঙে পড়েছে ধর্মীয় আত্মবিশ্বাস। ব্যাপারটা যেহেতু স্বাধীনতার, তাই ব্যক্তির সাথে জোরালোভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে একাকীত্ব আর বিচ্ছিন্নতা। নাই হয়ে গেছে জীবনের অর্থ। স্বাধীনতার মুক্ত অনুভূতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে এসেছে ব্যক্তির আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাহীনতা আর ভয়। স্বর্গ হারিয়ে গেছে। ব্যক্তি এখন একা দাঁড়িয়ে মুখোমুখি হয়েছে পৃথিবীর—যেন এক আগন্তুককে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে এক সীমাহীন এবং আতঙ্কজনক জগতে। নয়া স্বাধীনতায় গেঁড়ে বসেছে অসহায়ত্ব, সংশয় আর উদ্বেগ।

ভাবানুবাদ
[মূলঃ এসকেপ ফ্রম ফ্রিডম, এরিক ফ্রম]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *