আধুনিক দর্শনের শুরুর দিকটাকে সাধারণত দুইটা স্কুলে ভাগ করা হয়—এক, যুক্তিবাদীদের স্কুল এবং দুই, অভিজ্ঞতাবাদীদের স্কুল। এর মধ্যে রেনে দেকার্ত, বেনেডিক্টাস স্পিনোজা, ইমানুয়েল কান্ট ছিলেন যুক্তিবাদীদের অন্তর্ভুক্ত আর জন লক, জর্জ বার্কলি, ডেভিড হিউম ছিলেন অভিজ্ঞতাবাদীদের দলে। অনেক দার্শনিক ছিলেন যাদেরকে সহজে এই দুই দলের কোনটার একটাতেও ফেলা যেত না, কারণ তাদের একেকজনের মতামত জটিলভাবে আরেকজনের মতামতকে অধিক্রমণ করতো। এই দুই স্কুলের মূল পার্থক্যটা ছিল জ্ঞানতাত্ত্বিক—যেখানে তাদের মতভেদ দৃশ্যমান হয় আমরা কী জানতে পারি এবং যা জানতে পারি সেটা কীভাবে জানতে পারি এই ব্যাপারে। সহজভাবে বললে, অভিজ্ঞতাবাদীদের মতে জ্ঞান অর্জিত হয় কেবলমাত্র অভিজ্ঞতা থেকে, অন্যদিকে যুক্তিবাদীরা মনে করেন জ্ঞান কেবল যৌক্তিক চিন্তা দিয়েই অর্জন করা সম্ভব।
লিবনিজ ছিলেন যুক্তিবাদী। যুক্তির সত্য এবং তথ্যের সত্য বলে তিনি সত্যের যে পার্থক্য তৈরি করেছিলেন সেটা যুক্তিবাদ আর অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যকার বিতর্কের মধ্যে একটা টুইস্ট তৈরি করেছিল। তার দাবী ছিল, সকল জ্ঞানেই যৌক্তিক চিন্তা দ্বারা প্রবেশ করা সম্ভব। তবে মানুষের যুক্তিচিন্তার কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার কারণে তাকে অবশ্যই জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার উপরও নির্ভর করতে হবে।
আমাদের মনের ভেতরে এক মহাবিশ্ব
লিবনিজ কীভাবে এমন উপসংহারে আসলেন সেটা বুঝতে হলে আগে কিছুটা হলেও বুঝতে হবে তিনি অধিবিদ্যায় কী ধরণের চিন্তা ধারণ করতেন—মহাবিশ্বের গঠন নিয়ে তার ধারণা কেমন ছিল। তার মতে, বিশ্বের প্রতিটা অংশ, প্রতিটা ব্যক্তি আলাদা আলাদা ধারণা অথবা “ভাব” ধারণ করে এবং এই ভাব প্রতিটা জিনিসের সত্যকে ধারণ করে, এমনকি অন্য জিনিসের সাথে প্রতিটা জিনিসের যে সম্পর্ক সেটার সত্যও ধারণ করে এই ভাব। কারণ, মহাবিশ্বে সবকিছুই একে অন্যের সাথে সংযুক্ত। তিনি বলেন, একটা ভাব আরেকটা ভাবের সাথে সংযুক্ত এবং এটা সম্ভব যে—অন্তত নীতি অনুসারে—এই সংযুক্তিগুলোকে অনুসরণ করে কেবল যুক্তিচিন্তা ব্যবহার করে পুরো মহাবিশ্বের সত্যগুলোকে আবিস্কার করা। এই চিন্তার মাধ্যমেই লিবনিজ “যুক্তির সত্য” নামে ধারণার প্রবর্তন করেছিলেন। তবে যেহেতু মনুষ্যমন এসব সত্যের খুব অল্পই ধারণ করতে পারে (যেমন, গণিতশাস্ত্র), সুতরাং তাকে অবশ্যই অভিজ্ঞতার উপরও নির্ভর করতে হয়, যেখান থেকে এসেছে “তথ্যের সত্য”।
তাহলে আগামীকাল পৃথিবীর অপর প্রান্তে কী ঘটবে সেটা কি আজকে এখান থেকে জানা সম্ভব? লিবনিজ বলেন, মহাবিশ্ব গঠিত হয়েছে অসংখ্য অনন্য এবং সাধারণ উপাদান দিয়ে, যার নাম হল “মোনাদ অথবা পরমাণু”। প্রত্যেকটা পরমাণু অন্যসব পরমাণু থেকে আলাদা এবং প্রতিটা পরমাণুতেই পুরো মহাবিশ্বের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একসাথে উপস্থিত। এই উপস্থিতিটা সবগুলো পরমাণুর মধ্যে একটা সামঞ্জস্য তৈরি করে রেখেছে, যার ফলে আলাদা হওয়া সত্ত্বেও প্রতিটা পরমাণু একই উপাদানের ধারক ও বাহক। লিবনিজ বলেন, এভাবেই ঈশ্বর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন—একটা “পূর্ব নির্ধারিত” অবস্থায়।
লিবনিজ বলেন, প্রতিটা মনুষ্যমন একেকটা মোনাদ এবং প্রতিটা মনেই পুরো মহাবিশ্ব উপস্থিত। সুতরাং, নীতি অনুসারে, আমাদের মনের পরিধির বাইরে গিয়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে যা কিছু জানার আছে তার সবই আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব। যেমন, বিটলজুস নক্ষত্র নিয়ে আমার মনের ভাবকে বিশ্লেষণ করে এক সময় আমার পক্ষে আসল বিটলজুসের পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব। তবে, বাস্তবে এই তথ্য পর্যন্ত পৌঁছাতে যে পরিমাণ বিশ্লেষণের প্রয়োজন সেটা অসম্ভবভাবে জটিল—লিবনিজ এটাকে বলেন “অসীম”— এবং যেহেতু আমি এই বিশ্লেষণ শেষ করতে পারবো না, তাই বিটলজুসের তাপমাত্রা আবিস্কার করতে হলে আমাকে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত উপকরণ ব্যবহার করে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
তাহলে বিটলজুসের তাপমাত্রা কি যুক্তির সত্য নাকি তথ্যের সত্য? এটা ঠিক যে এই সত্য জানতে আমাকে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, কিন্তু এটাও ঠিক যে, যদি আমার চিন্তাশক্তি আরও শক্তিশালী হতো তাহলে শুধুমাত্র যুক্তিচিন্তা দিয়েই আমি সেটাকে জানতে পারতাম। এখন এটা যুক্তির সত্য নাকি তথ্যের সত্য সেটা নির্ভর করে সত্যটাতে আমাদেরকে কীভাবে পৌঁছাতে হবে তার উপর—কিন্তু লিবনিজ কি এটাই বলতে চাচ্ছিলেন?
অনুবাদ।। শরিফুল ইসলাম
[মূল – দ্যা ফিলোসফি বুক]