মনুষ্যভয় ও দ্বিধা

ন্যাচার অব রিয়্যালিটির নিষ্ঠুরতম দিকটা হল এখানে কোনকিছুই স্থায়ী নয়। সবকিছুই ক্ষয়ে যায়, মরে যায়। তবে এটা যে একটা নিষ্ঠুর ব্যাপার সেটার পর্যবেক্ষক শুধুমাত্র মানুষের মন। অর্থাৎ, যে-কোন বিয়োগে, মৃত্যুতে মনুষ্যমন যে কঠিন যন্ত্রণা ভোগ করে কেবল সেই অনুভূতির ভিত্তিতেই এখানে ‘নিষ্ঠুর’ শব্দটি উচ্চারণ করা যায়। মানুষের মনকে বাদ দিলে রিয়্যালিটিতে যা কিছু ঘটে তার সবই প্রাকৃতিক। তাহলে মানুষের মন কি প্রকৃতির বাইরের কিছু? তা তো হওয়ার কথা না। তবে মনুষ্যমনের একটা নিজস্ব প্রকৃতি রয়েছে। সে জড়াতে চায়, ছড়াতে চায়, ধরে রাখতে চায় এবং টিকে থাকতে চায়। এই চাওয়া হয়তো মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণেরও আছে। কিন্তু মনুষ্যমনের অনন্য বৈশিষ্ট্য হল সে জানে যে সে একদিন মারা যাবে। এটা একটা জ্ঞান। এই জ্ঞানই ভয়ের উৎস, যন্ত্রণার উৎস। এই জ্ঞান থেকে কোন মানুষেরই মুক্তি নেই। তবে মৃত্যুর মত এমন কিছু ফান্ডামেন্টাল জ্ঞানে সকল মানুষ সমভাবে জ্ঞানী হলেও, রিয়্যালিটির অন্য আরও অনেক কিছুর ব্যাপারে মানুষে মানুষে জ্ঞানের ফারাক অনেক। এক্ষেত্রে মানুষে মানুষে ভয়ের মাত্রাও হয় ভিন্ন। জ্ঞান যেহেতু ভয়ের উৎস, তাহলে এমনটা কি হতে পারে যে, যে যত জ্ঞানী, সে তত ভীত?

শিশুর কামড়ে যখন সাপের মৃত্যু হয়, তখন সেখানে যেটা কাজ করে সেটা হল, সাপের বিষ এবং মৃত্যু এই দুই বিষয়ে শিশুর মধ্যে জ্ঞানের অনুপস্থিতি। আর এই জ্ঞানের অনুপস্থিতি হল ভয়ের অনুপস্থিতি। জ্ঞান নেই তো ভয় নেই। কিন্তু ব্যাপারটা হয়তো এত সরলও নয়। যখন বলা হয়, ‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’, তখন এখানে একটা জ্ঞানের মাধ্যমে ভয়কে দূর করানো চেষ্টা করা হয়। মেঘ জমলেই যে সূর্যের অস্তিত্ব নাই হয়ে যায় না এবং মেঘ জমা যে একটা চিরস্থায়ী বিষয় নয়, সেটা একটা জ্ঞান। এই জ্ঞান হয়তো আপনার মেঘ জমাকালীন ভয় দূর করতে পারে। কিন্তু আপনার মন যখন বুঝতে পারবে যে, মেঘের পরে সূর্য হাসলেও, পরে আবারও আকাশে মেঘ জমে বজ্রপাত হয়ে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে এবং সেই মানুষটা আপনি নিজে কিংবা আপনার আপন কেউ হতে পারে, তখন সেই জ্ঞান আবার হয়ে উঠবে আপনার ভয়ের কারণ।

জ্ঞান যেমন মনুষ্যমনে ভয় তৈরি করে, তেমনি তৈরি করে দ্বিধাও। যদিও এই ভয় আর দ্বিধাই মানবজাতিকে এগিয়ে দিয়েছে সকল উন্নত আবিস্কারের পথে, তবে মানুষের চির আকাঙ্ক্ষিত সুখ অর্জনের পথে একমাত্র বাঁধা এই জ্ঞানই। কিন্তু সুখী হওয়াই কি মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ? দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছিলেন, একটা তৃপ্ত শূকর হওয়ার চাইতে একজন অতৃপ্ত মানুষ হওয়া উত্তম; একজন তৃপ্ত মূর্খ হওয়ার চাইতে একজন অতৃপ্ত সক্রেটিস হওয়া উত্তম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *