শোনা যায় গৌতম বুদ্ধের বোধিপ্রাপ্তির ঠিক আগেরদিন, যখন আধ্যাত্মিকতার চরম অনুশীলনে গৌতমের কঙ্কালসার দেহ প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি, তখন সুজাতা নামের এক যুবতী নারী তাঁকে এক বাটি দুধ আর ভাত খেতে দিয়েছিলেন। গৌতম সেই দুধ-ভাত গ্রোগ্রাসে গিলে যখন শরীরে শক্তি ফিরে পেয়েছিলেন, তখন তাঁর প্রথমবারের মত অনুধাবন হয়েছিল যে যেকোন চরমপন্থাই মনুষ্যপ্রাণের জন্য খারাপ। বোধিপ্রাপ্তির পরপর প্রথম ধর্মোপদেশে বুদ্ধ এক ‘মধ্যপন্থা’র কথা বলেন। বলেন যে মধ্যপন্থা অবলম্বন করলেই সবকিছু পাওয়া সম্ভব, নিজেকে পাওয়া সম্ভব।
জগতের যে শারীরিক বাস্তবতা আমাদের চোখের সামনে অস্তিত্বশীল, এখানে সকলকিছুই যেন যেকোন চরমের মাঝামাঝিতে অবস্থান করে। বিশেষ করে প্রাণ। আলো, বাতাস, অগ্নি, জল, তাপ, ঠাণ্ডা এই সবকিছুর এক মাঝামাঝি মিশ্রণে তৈরি হওয়া বায়ুমণ্ডলই পৃথিবী নামক এই গ্রহকে প্রাণের জন্য উপযোগী করে তুলেছে। প্রাণ ধারণকারী প্রাণীর দেহ কোন চরমপন্থায় বেশিদূর হাঁটতে পারে না। দেহ আগুনের ছ্যাঁকে আরামবোধ করলেও, চাক্ষুষ আগুনে টিকতে পারে না। দেহ কুয়াশা কিংবা তুষারের শীতল পরশে আরামবোধ করলেও, হিমশীতল বরফে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না। সবকিছুর একটা মাঝামাঝি মিশ্রণে প্রাণ ধেই ধেই করে নেচে উঠতে পারে, আবার কোন একটা মাত্রা চরমে উঠলেই সেই প্রাণের বিনাশ হয় সহজেই। এটা প্রাণের ভঙ্গুরতা, প্রাণীর দেহের ভঙ্গুরতা। তবে এই ভঙ্গুরতায় একটা নেশাতুর উত্তেজনাকর স্বাদ আছে। যে স্বাদ রহস্যময়।
প্রাণ এবং প্রাণীদেহের মধ্যমপন্থাধর্মী আচরণেই হোক কিংবা কোন বেহুদা কারণেই হোক দেহ টপকিয়ে প্রাণীর মনেও কাজ করে মানসিক ভারসাম্যের মাঝামাঝি অবস্থান। আর প্রকৃত মনধারী প্রাণী বলতে যেহেতু আমরা মানুষকেই বুঝি, এক্ষেত্রে মনুষ্য সাইকোলজির মাঝামাঝি পথ ধরেই আমরা এই আলোচনায় হাঁটতে পারি কিংবা হাঁটছি। মানুষের মনের মূর্ত কিংবা বিমূর্ত সব অনুভূতি কিংবা আকাঙ্ক্ষা মাঝামাঝি অবস্থানেই উপভোগ্য। এখানে একটা চলমান টানাপড়েন থাকবে কিন্তু কোনকিছুই ভেঙ্গে পড়বে না এমন একটা অবস্থানই মনুষ্য মনের ভারসাম্য ধরে রাখার মূল চাবিকাঠি। কিন্তু মানুষের মনের এক জন্মগত গভীর অসুখ আছে। সেটা হল, সে অনেক কিছুতেই ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় চরমে পৌঁছাতে চায়। আত্মঘাতী হলেও মন এই অসুখ কখনও নিজে থেকে সারাতে চায় না।
প্রাণধারী দেহ কিংবা দেহধারী প্রাণের নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য আগুন, পানি, বাতাস, খাদ্য যা যা মাঝামাঝি কিংবা সহনীয় অবস্থায় ভোগ করা প্রয়োজন তার সবকিছুই এই জগত তাকে প্রদান করার জন্য প্রস্তুত। সহনীয় মাঝামাঝি অবস্থানে অবস্থিত এই গ্রহ প্রাণী দেহের টিকে থাকার প্রাচুর্যে ভরা। কিন্তু এই প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও মানুষরা নিজেদের টিকে থাকার জন্য কোন এক অদ্ভুত কারণে প্রাচুর্য লেনদেনের এক মাধ্যম আবিস্কার করেছে। সেটা হল টাকা। প্রাকৃতিক কিংবা আসল প্রাচুর্যের প্রতিস্থাপনে টাকা মানুষের জীবনে এমন এক জিনিসে পরিণত হয়েছে, যেটা ছাড়া মানুষরা বেঁচে থাকতে পারে না। মজার বিষয় হল, এই টাকাও একটা সহনীয় কিংবা মাঝামাঝি মাত্রায় মানুষের জীবনকে যাপনের যোগ্য করে তুলতে পারে। কিন্তু মানুষের মন তার চরমে পৌঁছানোর স্বভাবটা এখানেই চর্চা করে বেশি। মানুষ টাকা চায়, চরম মাত্রায়। যেহেতু প্রকৃতির এক অদ্ভুত নিয়মে প্রাণ, দেহ আর মন কোন চরমেই টিকতে পারে না, তাই মাত্রাতিরিক্ত টাকার অভাব কিংবা মাত্রাতিরিক্ত টাকার অর্জন দুই চরমেই সে দুর্ভোগ পোহায়।
হোয়াং ডং-হাইউক-এর নির্মিত সিরিজ ‘স্কুইড গেইম’ টাকার প্রয়োজনীয়তা, ব্যবহার আর অর্জনের মাত্রাকে আমাদের নাকের ডগায় ঝুলিয়ে রাখে সারাক্ষণ। খেলাচ্ছলে। খেলা কী? হিন্দুয়িজমে বলা হয়, এই জগত হল এক লীলা। ব্রহ্মার স্বতঃস্ফুর্ত লীলা। শিশুরা সাধারণত বড় হয় নানান ধরনের খেলা করার মধ্য দিয়ে। কোন মনুষ্য শিশুই সম্পূর্ণ খেলাকে বাদ দিয়ে জীবনের পথে হাঁটতে পারে না। কিন্তু কেন? খেলার মূল নির্যাস হল এখানে একটা অর্থহীন আনন্দের উৎপত্তি হয়, যার মূল কারণ খেলাকে কেউ বাস্তব ধরে নেয় না। এখানে শিশুর খেলা আর ব্রহ্মার লীলা দুটোই আনন্দের উৎপত্তির কারণ হতে পারে সমভাবে। কিন্তু শিশু বড় হলে কেন যেন খেলার কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় যে স্কুইড খেলা হোক কিংবা গোল্লাছুট খেলা হোক এখানে জিতে গিয়ে কোটি টাকা পুরষ্কার পাওয়া অথবা হেরে গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা সবই একই খেলার আনন্দাংশ।