প্যারাসাইট

রাজতন্ত্র কিংবা অভিজাততন্ত্রের মত অত্যাচারি শাসন ব্যবস্থাকে ভেঙ্গেচুরে দিয়ে খৃষ্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীতে গ্রিসের এথেন্সে জন্ম নেয়া ডেমোক্রেসি তথা গণতন্ত্র যখন সারা পৃথিবী ছড়িয়ে সময় গড়িয়ে একসময় মডার্ন ডেমোক্রেসিতে রূপ নিয়েছে, তখন সেটাকে মনুষ্য প্রজাতির ইতিহাসের সবচাইতে বড় গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। কারণ, এখানে সাধারণত সাধারণ মানুষের একটা ব্যসিক সম্মানবোধ এবং ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে কিংবা করা হবে বলে বলা হয়ে থাকে। মনুষ্য মুক্তির তরে গণতন্ত্রের মত আরও অনেক বড় ঘটনা আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে গেছে। এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, মেরিটোক্রেসি তথা মেধাতন্ত্রের উত্থান। মেধাতন্ত্রের ধারণা অনেক আগে থেকে চলমান থাকলেও, ‘মেধাতন্ত্র’ শব্দটা মোটামুটি নতুনই। ১৯৫৮ সালে ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী মাইকেল ইয়াং তার লেখা বই ‘দ্যা রাইজ অব দ্যা মেরিটোক্রেসি’ তে মেধাতন্ত্রের বেশ নিন্দা করেছিলেন। মেধাতন্ত্র কী?

আগেকার দেবদেবী পূজারী কিংবা ঈশ্বরপন্থী রাজারা কিংবা অভিজাত শ্রেণীর লোকজন কোন দরিদ্র ব্যক্তিকে দেখলে মনে মনে কিংবা শব্দ করেই বলে উঠত ‘আহা, বেচারা দুর্ভাগা!’ দুর্ভাগা শব্দটা দিয়ে তারা বোঝাতো যে ঈশ্বরের সৃষ্টি সকল মানুষের ভাগ্য কিংবা নিয়তি ঈশ্বর দ্বারাই নির্ধারিত হয়। এখানে কেউ হতদরিদ্রের ঘরে জন্ম নিয়ে ভোগান্তি আর যন্ত্রণায় জীবন পার করলে সেটার জন্য তার নিয়তিই দায়ী। কারও কিছু করার নেই। কিন্তু গণতন্ত্রের মত মনুষ্য মুক্তির নীতি আবিষ্কারক আধুনিক মানুষরা জগতে সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে নিয়তিকে আর দায়ী করতে রাজি নয়। আধুনিক মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করলো যার যোগ্যতা আছে, মেধা আছে, মস্তিষ্কে বুদ্ধি আছে, সে যে বংশ কিংবা পরিবার কিংবা সামাজিক অবস্থানেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন, মেধার জোরে আর পরিশ্রমে সে চাইলেই সমাজের যে-কোন উঁচু অবস্থানে অধিষ্ঠিত হতে পারবে। এটাই মেধাতন্ত্র।

বর্তমানে সাধারণত যারা হত-দরিদ্র অথবা দরিদ্র সীমার নিচের শ্রেণীর মানুষ, তারা খুব একটা ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে না। তারা অনেকটা মেনেই নেয় যে, তাদের পক্ষে এই জগতে আর লক্ষ-কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা নেই। যাদের জন্ম ধনী পরিবারে তারা বিনা পরিশ্রমে অথবা সহজ পরিশ্রমে উত্তরাধিকার সূত্রে অভিজাত জীবন যাপন করে। তাদের ধন-সম্পদের পরিমাণ ক্যাপিটালিজমের প্রাকৃতিক নিয়মে দিন দিন বাড়তেই থাকে। তারা চাইলেও দরিদ্র হতে পারে না। কিন্তু পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে পড়ে। যারা ধনী নয়, কিন্তু ভেতরে ধনী হওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। তাদের এই আকাঙ্ক্ষার আগুনকে জ্বালিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন মেধাতন্ত্রের মত এক আইডিয়ার। এতে তারা স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন পূরণের জন্য কর্মঠ হয়ে উঠে। এতে তারা দৌড়ায়, ছোটে। তারা ছটফট করে আর পরিশ্রম করে।

কিন্তু মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে উপরে উঠার যে মই ক্যাপিটালিজমের এই জগতে আমরা দেখি, সেটা অনেক লম্বা, আঁকাবাঁকা এবং মাঝেমাঝে হাতের মুঠোতে মইয়ের ধাপগুলো ঠিকমত আঁটেও না। মাঝেমাঝে দেখা যায় যারা আমার কিংবা আমাদের আগে এই মই বেয়ে উঠে গেছে, তারা যাওয়ার সময় এটাকে পিচ্ছিল করে রেখে গেছে। অনেক চেষ্টা আর কষ্ট করে উঠতে গেলে উপরে থাকা অনেকে আবার মাঝে মধ্যে নিচের দিকে লাথি মারে। এরকম আরও হাজারও কারণে বেশিরভাগ মধ্যবিত্তরা আকাঙ্ক্ষার আগুন নিয়ে কোনদিনও সফলতার মই বেয়ে উপরে উঠতে পারে না। কিন্তু মেধাতন্ত্রে মূলনীতি হল কেউ সফল হতে ব্যর্থ হলে সফলতার মই কিংবা মইটাকে যারা পিচ্ছিল করেছে তাদেরকে দোষ দেয়া যাবে না। দোষ দিতে হবে নিজের চেষ্টাকে। নিজেকে বলতে হবে, আরও ভালো করে কেন চেষ্টা করলাম না, আরও আগে কেন মই বাওয়া শুরু করলাম না, আগে থেকে কেন চিন্তা করে রাখলাম না যে উপর থেকে কেউ আমাকে লাথি মারতে পারে?

কিন্ত মাইকেল ইয়াং কিংবা ব্রিটিশ দার্শনিক এলাইন ডে বটনের মত বিজ্ঞেরা মেধাতন্ত্রের মত এমন আকাঙ্ক্ষার আগুন জ্বালানিয়া একটা ব্যাপারকে ভালো চোখে দেখেন না, যেমনটা দেখেন না সাউথ কোরিয়ান সিনেমা নির্মাতা বং জুন-হো। মেধাতন্ত্র যে কেবল একটা আইডিয়া মাত্র, চাইলেই যে কেউ সফলতার মই বেয়ে উপরে উঠে যেতে পারে না, সেটার এক গভীর মেটাফোর হিসেবে নির্মিত হয়েছে মুভি প্যারাসাইট (২০১৯)।

মুভির প্রধান চরিত্র কিম-কি-ও তার নিজের এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের তীক্ষ্ণ মেধা, চেষ্টা, পরিশ্রম আর সূক্ষ্ম পরিকল্পনা দিয়ে যেভাবে সফলতার মই বেয়ে উপরে উঠতে চেয়েছিলেন, সেটা আপাত দৃশ্যে শয়তানি ভঙ্গিমায় হলেও, মেধাতন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করলে তারা সফল হতই। কিন্তু না, সিনেমার গল্পের মত করে হলেও কিম-কি-ওরা সফল হতে পারেনি, ধনী হতে পারেনি, টপকাতে পারেনি নিজের শ্রেণীকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *