গ্রিক মিথোলজির রাজা থেসিয়াস বিখ্যাত হয়েছিলেন মিনোয়ার ক্রিটের পৌরাণিক জন্তু মিনোয়াতোরকে হত্যা করে। মিনোয়াতোর ছিলেন অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ষাঁড়াকৃতির এক প্রাণী। থেসিয়াস মিনোয়ার থেকে মিশন শেষে যে জাহাজে করে এথেন্সে ফিরেছিলেন সেই বিখ্যাত জাহাজকে বলা হয় ‘শিপ অফ থেসিয়াস’। মিশন পরবর্তী সময়ে জাহাজখানাকে গ্রিসের একটা বন্দরে মেমোরিয়াল হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিলো। সংরক্ষণের পর থেকে বছরের পর বছর পার হতে হতে কাঠের তৈরি এই জাহাজের বিভিন্ন অংশে ধীরে ধীরে পচন ধরা শুরু হতে লাগলো। যে অংশটায় পচন ধরতো সে অংশটাকে নতুন কাঠ দিয়ে মেরামত করে দেয়া হতো। এভাবে চলতে থাকলো আরও অনেক বছর। যখনই জাহাজের কোন অংশে পচন ধরে, সেটাকে নতুন কাঠ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়। এরকম করে যখন একটা শতাব্দী পার হয়ে গেল, তখন দেখা গেল যে পচন ধরা অংশ মেরামত করতে করতে এখন পুরো জাহাজটাই নতুন কাঠের অংশে প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ থেসিয়াসের আসল জাহাজের কোন অংশই এখন আর অবশিষ্ট নেই। এখন প্রশ্ন হল, এই মেরামতকৃত জাহাজটি কি আর থেসিয়াসের সেই আসল জাহাজ রয়ে গেল? এটাকে কি আমরা এখনও ‘শিপ অফ থেসিয়াস’ বলতে পারি? যদি এমন হয় যে জাহাজের যে পচন ধরা কিংবা ভেঙে যাওয়া অংশগুলো সময়ে সময়ে সরানো হয়েছিল, সেগুলোকে এক জায়গায় জমা করে রাখার আরেক শতাব্দী পর এমন এক প্রযুক্তি আসলো যার মাধ্যমে এই টুকরো কাঠগুলো দিয়ে পুরো জাহাজটাকে পুনর্নির্মাণ করা যাবে, তাহলে এটাকেও কি আমরা থেসিয়াসের জাহাজ হিসেবে বিবেচনা করবো? যদি করি, তাহলে মেরামতকৃত ঐ জাহাজটাকে কী হিসেবে দেখবো?
গ্রিসে আইডেন্টিটি নিয়ে যে দর্শনচর্চা হতো সেখানে এটাকে একটা থট এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে দেখা হত, যেখানে দার্শনিক হেরাক্লিটাস ও প্লেটো অস্তিত্বের আইডেন্টিটি সম্পর্কিত এসব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতেন। এইসব প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। ন্যাচার অব রিয়্যালিটি আর নিজেকে জানার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
মনুষ্যমনের একটা সাধারণ প্রবণতা হল সে প্রকৃতিতে খুবই অল্প কিছু জিনিস যেমন আগুন, পানি, বাতাস এবং অন্যান্য জিনিসের ক্ষেত্রে অল্পকিছু মুহূর্ত ছাড়া প্রায় সবসময়ই সবকিছুকে স্থির অথবা ফিক্সড হিসেবে দেখে। সেজন্য সে সবকিছুর গায়েই একটা নাম বসায়। অর্থাৎ মানুষ প্রকৃতির সবকিছুকে নামপদ তথা নাউন হিসেবে দেখে। যেমন বৃক্ষ, দালান, নদী, জল, মানুষ ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃতিতে আসলে কোন নামপদ নেই, যা আছে সবই ক্রিয়াপদ। কারণ প্রতিটা জীব ও জড় বস্তু প্রতিনিয়ত একটা চলমান পরিবর্তনের উপরে থাকে, সেই পরিবর্তন যত ধীরই হোক না কেন, কোনকিছুই অস্তিত্বে স্থির কিংবা স্থায়ী নয়। যখন অস্তিত্বে কোনকিছুই স্থির নয়, সবকিছুই একটা চলমান পরিবর্তনের উপরে থাকে, তখন কোনকিছুর কোন স্থায়ী পরিচয় থাকে না। কিন্তু মনুষ্যমন প্রকৃতির এই ব্যাপারটাকে উপেক্ষা করে যায়। কারণ মন নিজে অস্থির হলেও, প্রকৃতিকে বোধগম্য করতে তার সবকিছুকে একটা নির্দিষ্ট ফ্রেমে ফেলে একটা স্থিরতায় এনে ঠাহর করতে হয়।
যেখানে প্রকৃতিতে কোনকিছুই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই এবং কোনকিছুরই অস্তিত্বগত নির্দিষ্ট কোন নাম নেই, সেখানে মানুষ হিসেবে আপনার-আমারও কোন পরিচয় নেই। আপনি কে? কিংবা আমি কে? থেসিয়াসের জাহাজে যেমন একটার পর একটা অংশ পরিবর্তিত হয়ে নতুন কাঠ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে, আপনিও দেহে ও মনে প্রতি মুহূর্তেই নতুন রক্তকণিকা, নতুন কোষ আর নতুন চিন্তা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যাচ্ছেন। দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেন, “আপনি চাইলেও কখনই এক নদীতে দুইবার ঝাঁপ দিতে পারবেন না।”