চাইনিজ দার্শনিক চুয়াং জু একবার স্বপ্নে দেখলেন যে তিনি একটা প্রজাপতি হয়ে মনের আনন্দে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছেন। স্বপ্নের মধ্যে প্রজাপতিটা জানতো না যে এটা আসলে চুয়াং জু স্বপ্ন দেখছেন যে উনি একটা প্রজাপতি। কিছুক্ষণ পর তার ঘুম ভেঙে গেল। জেগে উঠে তিনি দ্বিধান্বিত হয়ে গেলেন এই ভেবে যে ‘আমি চুয়াং জু স্বপ্ন দেখলাম যে আমি একটা প্রজাপতি, নাকি একটা প্রজাপতি এখন স্বপ্ন দেখছে যে এটা চুয়াং জু?’। চুয়াং জু আর প্রজাপতিটার মধ্যে একটা পার্থক্য অবশ্যই থাকার কথা।
চুয়াং জু’র অনুভূত স্বপ্ন আর জাগরণের মধ্যকার কনফিউশন সকল মনুষ্যমনের জন্য প্রায় শাশ্বত। মানুষ ঘুমালে যে স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়ে সেখানে সে প্রায় সম্পূর্ণ ভুলে যায় যে এটা স্বপ্ন। যখন ঘুম ভাঙে, তখন সে তথাকথিত বাস্তব জগতে আবার ফিরে আসে। কিন্তু স্বপ্ন আর জাগরণের মাঝখানে একটা ক্ষুদ্র ট্রানজিশনের মধ্য দিয়ে মনকে যেতে হয়, যেটাকে বলা হয় ‘মেটেসাইকোসিস’।
সাধারণত বলা হয়ে থাকে যে প্রতিটা মানুষের অযাপিত জীবন আর অপূর্ণতা তার স্বপ্নের মধ্যে উঠে আসে। সেজন্য সাইকোলজিস্ট ফ্র্যয়েড মানুষকে জানতে-বুঝতে তাদের দেখা স্বপ্নের উপরই নির্ভর করতেন। মানুষের মন যা চায় তা সে পায় না। যেটুকু পায় সেটুকুতে মন কখনই সন্তুষ্ট হতে পারে না। এটা একটা স্ট্রাগল। এই স্ট্রাগল মানুষকে বিবর্তিত করেছে। এই স্ট্রাগল ভালো নাকি খারাপ সেটার থেকে বড় প্রশ্ন হল এই স্ট্রাগল কেন? কিন্তু এই কেন’র উত্তরে কজ এন্ড ইফেক্টের ধারায় কিছু ব্যাসিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া গেলেও, মূল এক্সিসটেনশিয়াল উত্তরটা খুঁজে পাওয়া যায় না, যেহেতু মনুষ্য অস্তিত্ব আমাদের বোধগম্য নয়।
কেন মনুষ্যমন কখনই স্থায়ী সন্তুষ্টিতে পৌঁছাতে পারে না? একটা প্রাণীর ভেতর মনের অস্তিত্বই বা কেন উদয় হল?
মনের অসন্তুষ্টির যে স্ট্রাগল আমরা দেখি এটার আপাত মূল উদ্দেশ্য হল জীবনের বরাদ্দকৃত সময় কাটানোর নাটকটাকে চালিয়ে যাওয়া। সন্তুষ্টিতে কোন নাটকীয়তা নেই। আর নাটকীয়তার অনুপস্থিতি মনের কাছে মৃত্যুসম ব্যাপার। যেটা চাই সেটা পাওয়ার আশা আর দৌড় এবং পেয়ে গেলে নতুন আরেকটা কিছু পাওয়ার নতুন আশা আর নতুন দৌড়ই হল জীবনের অর্থহীন সময়টাকে কাটানোর একমাত্র উপায়। তবে সাধারণত মানুষ ভেবে নেয় যে সে বোধহয় সবসময় উত্তম কিছু পাওয়ার জন্য, উন্নত কিছু পাওয়ার জন্য, বড় কিছু পাওয়ার জন্য, ভারী কিছু পাওয়ার জন্যই আকাঙ্ক্ষা আর অসন্তুষ্টি অনুভব করে। কিন্তু তা নয়। মনের অসন্তুষ্টি উভমুখী। কেউ তিনবেলা ঠিকমত আহার না পাওয়ার অসন্তুষ্টিতে ভুগতে পারে, আবার কেউ বিলিয়নিয়ার হয়ে ভর দুপুরে গাছের ছায়ায় বাঁশের বেঞ্চিতে গ্রাম্য কৃষকের মত জীবন-দৌড়ের বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ চাপমুক্ত নাকডাকা একটা ঘুম দিতে না পারার অসন্তুষ্টিতেও ভুগতে পারে। সেজন্য কেউ একজন বলে উঠেন, “ইউর স্মল লাইফ ইজ সামওয়ান এলসে’স বিগ ড্রিম।”
আপনি এখন জীবনের যে স্তরে আছেন এবং আপনার দখলে কিংবা অধিকারে যা কিছু আছে তা নিয়ে আপনার যতই অসন্তুষ্টি কাজ করুক না কেন, ঠিক ততটুকু অধিকারের অধিকারী হওয়ার স্বপ্নে অন্য অনেক মানুষের মন এই মুহূর্তে বিভোর হয়ে আছে। যেমনটা হয়ে আছেন আপনিও অন্য কারও সম দখলদারিত্বের স্বপ্নে বিভোর।
কিন্তু এই সন্তুষ্টি আর অসন্তুষ্টি, স্বপ্ন আর জাগরণ, যাপিত এবং অযাপিত জীবনের বাইনারি অপোজিশনের কোনটা সত্য, আর কোনটা মিথ্যা? এমন প্রশ্নের গভীরতায় বিভোর হয়েছিলেন ভারতীয় কবি কনকদাস। তার নি মায়াওলাগো কবিতা পড়ে আভ্যন্তরীণ এক জ্বালায় সিনেমা পরিচালক পাওয়ান কুমার সৃষ্টি করেন “লুসিয়া”।
কনক দাস প্রশ্ন করেছিলেন,
তুমি কি কেবলই একটা ভ্রমের সৃষ্টি? নাকি তুমিই সৃষ্টি করো ভ্রম?
তুমি কি এই শরীরের একটা অংশ? নাকি শরীরটা তোমারই একটা অংশ?
এই ঘরের ভেতরেই কি শূন্যতা বিরাজমান? নাকি শূন্যতায় বিরাজ করে এই ঘর?
নাকি ঘর আর শূন্যতা দুটোরই অস্তিত্ব শুধু চোখের দৃষ্টিতে?
চক্ষুটা কি মনের ভেতরে থাকে? নাকি মনটা এই চোখের ভেতর?
নাকি মন আর চোখ দুটোই থাকে কেবল তোমার ভেতর?
মিষ্টতা কি চিনিতে ঘুমায়, নাকি মিষ্টতার বুকে শুয়ে থাকে চিনি?
নাকি চিনি আর মিষ্টতা দুটোরই অস্তিত্ব কেবল জিহবায়?
সৌরভ কি ফুলে থাকে? নাকি ফুলটাই ডুবে রয় সৌরভে?
নাকি ফুল আর গন্ধ দুটোরই বসবাস কেবল নাসারন্ধ্রে?
আমি জানি না কোথায় থাকে কোনটা, হে ঈশ্বর,
ওহে! অনুপম, এই সবকিছুই কি একত্রে বসবাস করে কেবল তোমার ভেতর?