মনুষ্যমনের আদিম এক কল্পনা হল স্বর্গ। একটা চির আকাঙ্ক্ষিত জায়গা। তবে এটা কোন জায়গা না হয়ে কেবল একটা মানসিক অবস্থান হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু মানুষের মন এ ব্যাপারে নিজের ক্রেডিট নিতে খুব একটা রাজি না, যেখানে তার নিজের সাথে নিজের পরিচয় খুবই ক্ষীণ। তাই গড়পড়তায় মানুষ স্বর্গকে একটা জায়গা হিসেবেই দেখে। এমন একটা জায়গা যেখানে বাতাসে হালকা উষ্ণতা বিরাজ করে, নাতিশীতোষ্ণ, ফুল, পাখি, সবুজ, রং, পরিষ্কার জলের স্রোতস্বিনীসহ আরও নানান কিছু। স্বর্গ দেখতে অনেকটা পৃথিবীর বসন্ত ঋতুর মতই। তবে সেটা চিরস্থায়ী। এখানে পুরোটাই মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষিত আরাম-আয়েশের একটা চূড়ান্ত পর্যায়।
পৃথিবীর শীত প্রধান দেশগুলোতে বছরে স্বল্প সময়ের জন্যে গ্রীষ্ম কিংবা বসন্ত এলে এমন স্বর্গেরই প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। কিন্তু সেটা থাকে না বেশিদিন, চলে যায়, আবার আসে, যেমনটা থাকে না মনুষ্য মনের জমে থাকা ক্লেদ কিংবা ভারী বর্ষণে ডুবে যাওয়া ক্ষেতের জল। কিন্তু মন চূড়ান্ত এক আরামের পর্যায়ে যেতে চায়। সে এইসব আসা-যাওয়ার ব্যাপারটা পছন্দ করে না। হালকা উষ্ণ হাওয়ায় আরাম করে তৃষ্ণা মিটিয়ে সীমাহীন যৌন স্বাদে ডুবে গিয়ে একটা স্থায়ী বন্দোবস্তে যাওয়া হল মনুষ্য মনের চিরকালের চাওয়া। ধর্ম ব্যাপারটাকে বিলম্বিত করে পরকালে নিয়ে গেছে যদিও। তবে ধর্মহীনরাও দেহ আর মনকে একটা আরামের স্রোতেই ধরে রাখতে চায়। কেন?
জন্ম নিলেই জীবদ্দশায় মনুষ্য প্রাণ যন্ত্রণার অলিতে-গলিতে মাঝে মাঝে বসন্তের দেখা পেয়ে যায়। শরীরে আর মনে আরামের ছোঁয়া লাগে। তখন নেশাতুর হয়ে উঠে মনুষ্য সাইকোলজি। এমন নেশায় সে ভুলে যায় যে স্বর্গকে উপভোগ করার জন্যে, এর হালকা উষ্ণতাকে ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নেয়ার জন্যে দরকার হয় এক স্পর্শকাতর দেহ, স্পর্শকাতর মন। স্পর্শকাতর ও ভঙ্গুর। যে দেহ এবং মন আতঙ্কে আর ভয়ে কেঁপে উঠে, সেই মন আর দেহেই আকাঙ্ক্ষা জাগে স্বর্গের। দেহ-মন চিরস্থায়ী লৌহ দ্বারা তৈরি হলে সে অনুভূতির রাজ্যে প্রবেশই করতো না কোন কালে।
জীবন একটা বসন্ত। এখানে ইন্দ্রিয়রা ফুল। কিন্তু এই বসন্ত আসে মরণের মধ্য দিয়ে, যেখানে ইন্দ্রিয়রা কাঁটা। যে ইন্দ্রিয় ফুলের সৌরভে মেতে উঠে, সে ইন্দ্রিয়ই ছড়িয়ে বেড়ায় রক্তের গন্ধ। এমনই ভয়ানক জীবন। যে-কোন জীবন। সুন্দরতম প্রস্ফুটিত পুষ্প বৃক্ষের গোঁড়ায়ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে কোন এক মেটে পোকা। একই সময়ে এমন জীবন-মৃত্যুর খেলা চলে অস্তিত্বে। কেন? এর অর্থ কী?
এর অর্থ দুর্বোধ্য। তোমার শুরু দুর্বোধ্যতা থেকে, শেষও দুর্বোধ্যতায়।