মনুষ্য ব্যক্তি সত্তার ভয় আর অসহায়ত্বের উৎস হল মানুষের অনুভূত আমিত্ববোধ। এখানে ভয় কিংবা অসহায়ত্বকে পুরোপুরি নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করার কোন সুযোগ নেই। এইসব অনুভুতিই আমিত্ববোধকে লোভনীয় করে তোলে। জন্মের পর থেকে শুরু করে সবকিছুকে একটা আমি’র বিপরীতে দাঁড় করিয়ে মৃত্যুর রেখায় পা ফেলার দৌড়ে যে নাটকীয়তার স্বাদ পাওয়া যায় তাতে জীবনকে অতটা তেতো বলে মনে হয় না কিংবা জীবনে এর বাইরে আর কিছু থাকতে পারে বলেও বোধ হয় না। আমিত্ববোধে এক চলমান হাহাকার থাকে, যেটা যোগ-বিয়োগের হিসেবে একটা টানাপড়েনের উত্তেজনায় টইটম্বুর হয়ে উঠে। মানুষের আমিত্ববোধ সম্পূর্ণ ভেতরগত ব্যাপার হলেও বাহিরের আপাত নৈর্ব্যক্তিক বৈচিত্র্য এই বোধকে আরও জোরালো করে তোলে। যেখানে কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখতে মেহগনি গাছের থেকে ভিন্নরকম, যেখানে রাজহাঁসের কণ্ঠস্বর দাঁড়কাকের ডাকের চেয়ে ভিন্নরকম, যেখানে জলের সাথে আগুনের কোন মিল নেই, সেখানে – পুরো অস্তিত্বে – এক বিচ্ছিন্নতার – বৈচিত্র্যের আন্দোলন বিদ্যমান। এই বৈচিত্র্যে মানুষ তার আমিত্বকে উপভোগ করতে চায় একদম তলানি পর্যন্ত। চাইবে এটাই স্বাভাবিক। এটা একটা লোভ। এই লোভও নেতিবাচক কিংবা ইতিবাচক কোন ব্যাপার নয়। এটা একটা প্রকৃতি। যেখানে প্রাণের নিজস্ব এক শাশ্বত স্বভাব হল নিজেকে যে-কোন রূপে চলমান রাখা, সেখানে বিবর্তিত মনুষ্যমনের কাজ হল প্রাণের উপর ভর করে আমিত্বের পূর্ণতায় লোভী হয়ে উঠা।
তবে আমিত্ববোধের এই লোভ তেমন বড় কোন লোভ নয়। যখন কোন মানুষ অস্তিত্বের এই বৈচিত্র্যের রিপিটেশনের ধারাটা জীবদ্দশার কোন এক সময় কোনরকমে দেখে ফেলতে পারে, তখন বিচ্ছিন্নতা তার চোখে এসে ধরা দেয় এক গভীর ভ্রম হিসেবে। ক্ষুদ্র আমিত্বের লোভনীয় স্বাদ তখন জিহ্বাকে আর সিক্ত করে তুলতে পারে না। তখন জেগে উঠে আরও বড় লোভ। এটা আধ্যাত্মিক লোভ। যথেষ্ট লোভী হলে মানুষ আমিত্বকে ছেড়ে দিতে চায়। এই ছেড়ে দেওয়ায় ঈশ্বরত্বের ভার এসে চাপে ঘাড়ে। বিচ্ছিন্নতা টপকে গিয়ে সবকিছুর সাথে এক হয়ে গেলে কিংবা ঈশ্বর হয়ে গেলে তখন আর ব্যক্তি সত্তার স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। সাধারণত স্বাধীনতার অনুভূতি জাগে মানুষের আমিত্ববোধে। আমি’কে বিচ্ছিন্নকরণের শর্তের মধ্যেই স্বাধীনতা পড়ে। কিন্তু একত্বে – অস্তিত্বে – ঐশ্বর্যে স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই। তবে এই স্বাধীনতা নেই অর্থ বন্দিত্ব নয়। প্রাণে – প্রাণের বৈচিত্র্যে আর অপ্রাণের একত্বতায় যখন কোন মনুষ্যমন বিলীন হয়, সেখানে ব্যক্তি হয়ে হয়ে উঠে পুরোপুরি শূন্য। সে হয়ে উঠে অস্তিত্বের মূল উৎস। এই শূন্যের উপরই চলে প্রকৃতির রিপিটেশনের খেলা। তখন ভিন্নতা তৈরি হয় রাজহাঁসের কণ্ঠস্বর আর দাঁড়কাকের কা-কা চিৎকারে। যথেষ্ট লোভীরা বুঝতে পারে প্রকৃতির রিপিটেশনে ভালো করে চোখ ফেললেই সেটা এক সীমাহীন অর্থহীনতায় পর্যবসিত হয়। কারও নাম একটানা অনেকবার উচ্চারণ করে দেখলে দেখা যায় সেটা এক পর্যায়ে গিয়ে আবোলতাবোল শোনাচ্ছে। এটা ছোট বাচ্চারা মাঝে মাঝে খেলা হিসেবে খেলে।
মানুষের শরীর যেমন জীবমণ্ডল আর বায়ুমণ্ডলকে খায় এবং নিজেকে খাওয়ায়, তেমনি তার চিন্তাও নিজে খায় এবং নিজেকে খাওয়ায় শূন্যমণ্ডল দ্বারা। আবার তার চিন্তাই বহন করে তার শরীরকে। অর্থাৎ এখানে সবকিছুর মূল উৎস হল নাথিংনেস। শূন্যে আলাদা করে কোন সত্য নেই। পুরোটাই একটা আস্ত সত্য কিংবা মিথ্যা। সত্য আর মিথ্যার পার্থক্যটাও এখানে অর্থহীন। একজন যথেষ্ট লোভী ব্যক্তি কিংবা ঈশ্বর ভুলে যায় দৃষ্টি আর দৃশ্যত বস্তুর মধ্যকার পার্থক্যের কথা। ভুলে যায় প্রাণ আর অপ্রাণের বৈপরীত্য। দার্শনিক নিৎশে বলেন, তুমি যদি পাতালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকো, দেখবে পাতালও তোমার দিকে তাকিয়ে আছে।