মানুষ একটা মেশিন

যদিও থমাস হবস মূলত তার রাজনৈতিক দর্শনের জন্য সুপরিচিত, আন্যান্য বিষয়ে তার লেখার পরিমাণও কম নয়। তার বেশীরভাগ চিন্তাধারাই বিতর্কিত, এর মধ্যে রয়েছে ফিজিক্যালিজমের পক্ষে তার জোর গলার সাফাই—যে তত্ত্বানুসারে বলা হয় যে জগতের সবকিছুই শারীরিক, এখানে শরীর ব্যতিত অন্য কোন অস্তিত্ব, যেমন মন অথবা অতিপ্রাকৃতিক কোন সত্তার জায়গা নেই। হবসের মতে, মানুষ সহ সকল প্রাণী রক্ত-মাংসের মেশিনের বেশি আর কিছুই নয়।

সতের শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, যখন হবস লেখালেখি করতেন, তখন তিনি যে ধরনের অধিবিদ্যার পক্ষে ছিলেন সেগুলো দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলো। দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিলো ফিজিক্যাল সাইন্সের জ্ঞান, উন্মোচিত হচ্ছিলো সেসব ঘটনার পরিষ্কার ব্যাখ্যা, যেগুলোকে মানুষ আগে বুঝতে পারতো না, যেগুলো ছিল অস্পষ্ট।

‘আধুনিক বিজ্ঞানের জনক’ বলে পরিচিত ইতালিয়ান জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিওর সাথে দেখা হয়েছিল হবসের। এছাড়া বিজ্ঞানে বিপ্লব সাধনকারী চিন্তার অধিকারী ফ্রান্সিস বেকনের সাথেও উঠা-বসা ছিল তার।

তিনি বিশ্বাস এবং যুক্তির মধ্যকার আপাত দ্বন্দ্ব নিরসনের অনুসন্ধানকারী মধ্যযুগীয় দার্শনিকদের বিপক্ষে যথযাথ জবাব খুঁজে পেয়েছিলেন বিজ্ঞান এবং গণিতশাস্ত্রে। তৎকালে অন্যন্য চিন্তকদের মত হবসও মনে করতেন যে বিজ্ঞানের অর্জনের কোন সীমা নেই এবং প্রকৃতিতে এমন কোন ব্যাপার নেই যার উত্তর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দ্বারা দেয়া সম্ভব নয়।

হবসের থিওরি

হবসের প্রধান রাজনৈতিক লেখা ‘লেভিয়াথান’-এ তিনি দাবি করেন যে ‘মহাবিশ্ব পুরোটাই শরীরী।’ তিনি আরও বলেন, এখানে প্রতিটা শরীরেরই দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর গভীরতা আছে এবং যা কিছু বস্তু নয় সেটা এই মহাবিশ্বের অংশও নয়। তবে হবস আরও উল্লেখ করেন যে, যদিও মহাবিশ্বের সবকিছুই শারীরিক, এর মানে এই নয় যে আমরা চাইলেই সবকিছু বুঝে ফেলতে পারব। এর মধ্যে কিছু কিছু শরীর কিংবা বস্তু রয়েছে যা অননুভবনীয়, যদিও এগুলো বস্তুগত মাত্রা এবং আয়তন উভয়ই ধারন করে। এগুলোকে তিনি বলতেন ‘আত্মা’। এদের মধ্যে কিছু কিছুকে তৎকালে বলা হত ‘পশু আত্মা’, যা বেশিরভাগ প্রাণী, বিশেষ করে মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী। এইসব পশু আত্মা শরীরের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়ায় এবং বয়ে বেড়ায় নানান তথ্য, ঠিক যেভাবে বর্তমানে আমরা শরীরের নার্ভাস সিস্টেমকে ব্যাখ্যা করি সেভাবেই।

হবস মাঝে মাঝে ধর্মীয় ঈশ্বর এবং দেবতাদের উপরে তার শারীরিক আত্মার ধারণাকে প্রয়োগ করতেন। যাইহোক, অন্যান্য শারীরিক আত্মাকে বাদ দিলেও ঈশ্বরকে হবস ‘অশরীরী’ হিসেবেই চিন্তা করেছেন। তার মতে ঈশ্বর এমন একটা সত্তা যাকে পুরোপুরি বোঝার ক্ষমতা মানুষের কোনকালেই হবে না, সুতরাং একমাত্র ‘অশরীরী’ কথাটাই ঈশ্বরের অজানা সত্তাকে চিহ্নিত করার জন্য সম্মানজনক। হবস পরিষ্কার করে বলেন যে, সবগুলো ধর্মীয় সত্তা হল বিশ্বাসের ব্যাপার, এগুলো বৈজ্ঞানিক নয়, তবে ঈশ্বর মানুষের সকল বোঝাবুঝির বাইরেই থেকে যাবে। মানুষ শুধু এইটুকু বুঝতে পারবে যে ঈশ্বর আছেন এবং তিনিই এই ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুর কারণ এবং স্রষ্টা।

চৈতন্য কী?

হবস যেহেতু মানুষকে স্রেফ পদার্থ হিসেবে বিবেচনা করতেন—যেখানে মানুষ একটা জৈবিক মেশিন বৈ কিছু নয়, সেখানে মানুষের যে একটা মন আছে সেটার প্রকৃতি কী হতে পারে এই প্রশ্ন তাকে এক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন করে ফেলে। তবে মানুষের মনকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি।  তিনি বরং ব্যাপারটাকে বিজ্ঞানের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন, যার ভিত্তিতে তিনি একটা সাধারণ এবং খসড়া ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তবে এই ব্যাখ্যায়ও তিনি মনুষ্য মনের গতিবিধি যেমন, স্বতঃপ্রবৃত্ত গতি, ক্ষুধা এবং অনীহা—যে সকল ঘটনা একটি অধিযন্ত্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গবেষণা এবং ব্যাখ্যা করা যায় তার বাইরে তেমন কিছু বলেননি। আধুনিক কালের অস্ট্রেলিয়ান দার্শনিক ডেভিড ক্যালমার্স এটাকে বলেছিলেন “চৈতন্যের কঠিন সমস্যা”, তবে হবস এটা নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি। ক্যালমার্স বলেন, চৈতন্যের নির্দিষ্ট কিছু ফাংশন আছে—যেমন, ভাষার ব্যবহার এবং তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ—এগুলোকে পদ্ধতিগত ভাবে তুলনামূলক সহজ পন্থায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব এবং ফিজিক্যালিস্ট দার্শনিকরা শত শত বছর ধরে এই পদ্ধতিরই নানান বিকল্প প্রস্তাব করে এসেছেন। যাইহোক, মনের সাবজেক্টিভ প্রকৃতি ব্যাখ্যা করাটাই ছিল সবচাইতে কঠিন ব্যাপার, যেখানে চৈতন্যের উত্তম-পুরুষের অভিজ্ঞতার ধরনটা কী সেটা অমীমাংসিতই থেকে যায় তাদের কাছে। দেখা যায় যে, ফিজিক্যাল সাইন্সের বস্তু আর চৈতন্যের অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েই আছে সৃষ্টিগত ভাবে—যেটার ব্যাপারে হবস কোন কিছু জানতেন বলে মনে হয় না। মানুষ সহ অন্য সকল কিছুই যে শারীরিক, হবসের এই বিশ্বাসের পক্ষে তাকে যুক্তি প্রদান করতে দেখা যায় খুবই অল্প। তার অতীন্দ্রিয় শারীরিক আত্মার যে ভিত্তির কথা তিনি বলেছেন সেই একই ভিত্তিতে যে অশরীরী উপাদানের কথা ব্যাখ্যা করা যায় সেটা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন কিংবা খেয়াল করেননি। বেশিরভাগ মানুষই অতীন্দ্রিয় কোন জিনিসকে শারীরিকের চেয়ে মানসিকের সাথেই মেলাতে পারে। অধিকন্তু, যেহেতু হবসের শারীরিক আত্মার গঠন অন্য সব বস্তুর মতই, তাই এটা মানুষের মনের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে কোন প্রকারের অবদান রাখতে পারেনি।

দেকারতের দ্বৈতবাদ

১৬৪১ সালে প্রকাশিত দেকারতের ‘মেডিটেশনস’ বইতে মানুষের শরীর আর মন নিয়ে যে ভিন্ন চিন্তা প্রকাশিত হয় সেটাকে খণ্ডানোর চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিলেন হবস। দেকারত সেখানে শরীর আর মনের মধ্যকার “সত্যিকার পার্থক্য”-এর কথা বলেছিলেন। তার মতে, শরীর আর মন দুটি সুস্পষ্ট ভিন্ন ভিন্ন উপাদান। তৎকালে দেকারতের এইসব কথাবার্তা বলাকালীন সময়ে হবস কোন প্রকারের মন্তব্য করেননি। তবে ১৪ বছর পর, তার “দে করপোরে” বইয়ের অনুচ্ছেদে তিনি দেকারতের যুক্তির একটা আবছা অংশের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, দেকারত যে শরীর আর মনকে সম্পূর্ণ দুটো আলাদা উপাদান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন সেটা গ্রহণযোগ্য নয়—যেখানে দেকারতের ব্যবহার করা বুলি “অশরীরী উপাদান” একটি তুচ্ছ কিংবা বাজে ভাষার উদাহরণ। হবস এই কথাটা দ্বারা বোঝাতে চান “একটি শরীর ছাড়া শরীর”, যেটা শুনতে আজগুবি শোনায়। যাইহোক, সকল উপাদানই শরীরী এই সংজ্ঞা দ্বারা হবস বোঝাতে চেয়েছেন যে, অশরীরী মন বলতে কিছু নেই, প্রকৃতিতে যত কাঠামো আছে এর সবকিছুই শারীরিক এবং এখানে অশরীরী কোনকিছুই অস্তিত্বশীল হতে পারে না।

একটি সাদাসিদা কুসংস্কার

হবস যখন শারীরিক আত্মার কথা বলতেন, তখন তিনি “শারীরিক” বলতে যে কী বোঝাতেন সেটা শেষপর্যন্ত পরিষ্কার বোঝা যায়নি। যদি শারীরিক বলতে তিনি তিন মাত্রার যে-কোন জিনিসকে বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে একুশ শতাব্দীর শুরুতে আমরা শারীরিক বলতে যা বুঝেছি তা থেকে অনেক কিছুই বাদ পড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, জগতের প্রকৃতি নিয়ে প্রদান করা তার সব থিওরি যদি সত্য হত, তবে পদার্থের পরমাণু বিজ্ঞান বাতিল হয়ে যেত।

যেহেতু হবসের মূল বুলিটার সত্যিকারের পরিষ্কার কোন অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়নি, তাই তাঁর জগত নিয়ে কেবল শরীর ভিত্তিক ব্যাখ্যাটি দিনে দিনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হিসেবে গুরুত্ব হারাতে শুরু করে। বরং এটাকে একটা অবৈজ্ঞানিক এবং মানসিকের বিরুদ্ধে অ-দার্শনিক কুসংস্কার মনে হতে থাকে। কিন্তু স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের এই জগতের প্রকৃতি নিয়ে তাঁর প্রদান করা থিওরিগুলো মানুষের প্রকৃতি এবং সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে পুরনো ধ্যান ধারণায় আমূল পরিবর্তনে জ্বালানী যুগিয়েছিল। পাশাপাশি যারা আমাদের এই মহাবিশ্বের কার্যপ্রণালী এবং উপাদান নিয়ে ভাবতেন তাঁদের চিন্তায়ও তেজ নিয়ে এসেছিল। এছাড়াও আধুনিক পৃথিবীর ভিত্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে এটা ছিল একটা বৈপ্লবিক চিন্তা।

অনুবাদ ।। শরিফুল ইসলাম
মূলঃ দ্যা ফিলসফি বুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *