খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতাব্দীর দিকে পেরিক্লিসের নেতৃত্বে পাণ্ডিত্য আর শিক্ষার এক ‘সোনালি দিন’-এ প্রবেশকারী শহর এথেন্স হয়ে উঠেছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী নগর-রাজ্য। গ্রীসের নানান জায়গা থেকে লোকজন তখন আসা শুরু করেছিল সেখানে। এদের মধ্যে যারা সেখানকার আইন বুঝতো এবং সেটাকে ব্যাখ্যা করতে পারতো, তাদের জন্য এই শহরটা ছিল ভালো একটা উপরি আয়ের জায়গা। প্রতিষ্ঠিত একটা লিগ্যাল সিস্টেমের উপর ভর করে বিশদাকারের কিছু গণতান্ত্রিক নিয়মের চলতো শহরটা। কেউ আদালতে গেলে নিজেই নিজেকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে হতো, কারণ সেখানে কোন আইনজীবী ছিল না, যদিও সেখানে অল্পদিন পরেই একটা স্বীকৃত উপদেষ্টা দলের আবির্ভাব হয়েছিল। প্রোটাগোরাস ছিলেন এই দলেরই একজন।
সবকিছুই আপেক্ষিক
যাদের সামর্থ্য ছিল, তাদেরকেই প্রোটাগোরাস আইন এবং অলংকারশাস্ত্রে শিক্ষা দিতেন। তার শিক্ষার মূল বিষয়গুলো ছিল ব্যবহারিক ব্যাপার, যেখানে কোন তর্কে জেতার চেয়ে বেসামরিক মামলায় জেতাটাই ছিল মুখ্য। কিন্তু এইসব শিক্ষার দার্শনিক তাৎপর্যটাও তার চোখ এড়ায়নি। প্রোটাগোরাসের মতে, প্রত্যেকটা যুক্তিরই দুটো দিক থাকে এবং হতে পারে এখানে দুটো দিকই ঠিক। তিনি দাবি করেন, যুক্তির উপযুক্ততা প্রমাণ না করে বরং প্রবক্তার মতবাদ প্রমাণের মাধ্যমে তিনি সবচাইতে খারাপ মামলাকেও ভালোতে পরিণত করতে পারেন। এতে করে তিনি বুঝতে পারলেন যে বিশ্বাস জিনিসটা হল মানসিক। যে-কোন দৃষ্টিভঙ্গি অথবা মতামতের মূল্য নির্ধারকের মাপকাঠি হল সেটার ধারক নিজেই। আইনি এবং রাজনৈতিক যুক্তি খণ্ডনের ক্ষেত্রে যুক্তি খণ্ডানোর এই ধরণটা ছিল তৎকালের দর্শনের নতুন বিষয়। মানুষকে সবকিছুর কেন্দ্রে বসিয়ে দার্শনিক যুক্তি থেকে ধর্মকে সরিয়ে দেয়ার একটা প্রথা চালু করেছিল এটা এবং দর্শনের ফোকাসকে ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃতি বোঝাবুঝির ব্যাপার থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মানুষের প্রকৃতি বোঝার অনুসন্ধানে।
প্রোটাগোরাস মূলত ব্যবহারিক প্রশ্নাবলীতে আগ্রহী ছিলেন। ব্রহ্মাণ্ড কী দিয়ে তৈরি অথবা ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে নাকি নাই এসব ব্যাপার নিয়ে দার্শনিক জল্পনা করাটা তার কাছে অর্থহীন মনে হতো, যেহেতু তিনি মনে করতেন যে এসবের মূল সত্য আমাদের পক্ষে কখনই জানা সম্ভব না।
‘মানুষই সবকিছুর মাপকাঠি’ এই চিন্তার মূল তাৎপর্য হলঃ বিশ্বাস জিনিসটা মানসিক এবং আপেক্ষিক। এই চিন্তার উপর ভর করে প্রোটাগোরাস সত্য, সুবিচার অথবা সততার চিরন্তন সংজ্ঞাকে বাতিল করে দেন। এই আপেক্ষিকতা অবশ্যই মানুষের ভালো-মন্দ নির্ধারণের মাপকাঠির উপরও প্রযোজ্য। তার মতে, কোনকিছুই সহজাতরূপে সাধু নয়। ব্যক্তি অথবা সমাজ নির্ধারণ করে বলেই কোন একটা ব্যাপার নৈতিক অথবা ন্যায়সঙ্গত হয়ে উঠতে পারে।
সফিস্ট (শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ সফিয়া থেকে, যার অর্থ প্রজ্ঞা) হিসেবে পরিচিত আইন এবং অলংকারশাস্ত্রের ভ্রাম্যমান শিক্ষকদলের মধ্যে প্রোটাগোরাস ছিলেন সবচাইতে প্রভাবশালী। সক্রেটিস এবং প্লেটো সফিস্টদেরকে মামুলি অলংকারশাস্ত্রবিদ হিসেবে উপহাস করলেও—জগতে কোনকিছুই চিরন্তন নয় এবং সকল সিদ্ধান্ত অথবা ফয়সালা অথবা রায়, এমনকি নৈতিক রায়ও যে একটা মানসিক ব্যাপার—এই দৃষ্টিভঙ্গিটা প্রোটাগোরাসের চোখে ছিল নীতিশাস্ত্রের জগতে একটা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
অনুবাদ ।। শরিফুল ইসলাম
মূলঃ দ্যা ফিলসফি বুক