লাও জুঃ যে পথের কথা বলা যায় তা শাশ্বত নয়

খৃষ্টপূর্ব ছয় শতাব্দী। চীনে তখন জৌ রাজবংশের শাসনে ছেদ পড়েছে। পাশাপাশি সেখানে ঘটে গেছে এক বড় ধরনের পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে চীনের আদালতগুলোতে জন্ম নিয়েছে প্রশাসনিক এবং ম্যাজিস্ট্রেটের একটা নতুন সামাজিক দল। সমাজকে কীভাবে আরও কার্যকরভাবে শাসন করা যায় সেই সম্পর্কিত স্ট্র্যাটেজি তৈরির কাজে এরা নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছে। এদেরকে একত্রে বলা হত ‘দ্যা হান্ড্রেড স্কুলস অব থটস’।
তৎকালে গ্রিক দর্শনের আবির্ভাব এবং এর প্রবাহের সাথে চীনা দর্শনের একটা জোরালো সংযোগ ছিল। গ্রীকদের মত এরাও জগতের অবিরত পরিবর্তনশীল অবস্থার মধ্যে একটা স্থিরতার সন্ধান করছিলো এবং তারা খুঁজছিল ধর্ম যা বলে গেছে তার বিকল্প পথ। কিন্তু যেহেতু চীনা দর্শন তখন বিবর্তিত হচ্ছিলো ব্যবহারিক রাজনীতি থেকে, তাই এরা নৈতিকতা এবং এথিক্স নিয়েই মূলত মাথা ঘামাতো, ব্রহ্মাণ্ডের আসল প্রকৃতি কী সেই চিন্তা নিয়ে ওদের তেমন কোন মাথাব্যাথা ছিল না।
ঠিক সেই সময়টাতে চীনে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে চিন্তার আবির্ভাব হয়েছিল সেটা হল ‘তাও তে চিং’ অথবা ‘দাও দে জিং’ (পথ এবং এর শক্তি)। এই চিন্তার জনক ছিলেন দার্শনিক লাও জু। তার ‘দে’ (গুণ) যা পরে পাওয়া যায় ‘দাও’ (পথ)-এ, এই থিওরির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দাওয়িজম।

পরিবর্তনের চক্র

দাও কী সেটা বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে প্রাচীন চীনারা এই নিরবিচ্ছিন্ন পরিবর্তনশীল পৃথিবীকে কীভাবে দেখত। চীনাদের মতে, জগতের সকল ধরনের পরিবর্তন হল চক্রাকার, সবকিছু এখানে এক অবস্থান থেকে আরেক অবস্থানে যাচ্ছে, যেমন দিন থেকে রাত, গ্রীষ্ম থেকে শীত ইত্যাদি। তারা দেখল যে প্রকৃতিতে যে-কোন দুটি ভিন্ন অবস্থান একটা আরেকটার সাথে সাংঘর্ষিক নয়, বরং এরা একে অন্যের সাথে জড়িত, একে অন্যের জন্মদাতা। এমনকি দুটি ভিন্ন অবস্থান এমন কিছু কম্পলিমেন্টারি উপাদান ধারন করে যা একত্রে মিলে একটা পূর্ণতার জন্ম দেয়। পরিবর্তনের এই ধারাটাকে বলা হয় দাও-এর প্রকাশভঙ্গি, আর এই প্রকাশভঙ্গির রয়েছে দশ হাজার রূপ, যা দিয়ে গড়ে উঠেছে পৃথিবী। লাও জু তার তাও তে চিং-এ উল্লখে করলেন যে মানুষ হল এই দশ হাজার রূপেরই একটি মাত্র এবং মানুষের আলাদা কোন বিশেষত্ব নাই। কিন্তু যেহেতু মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা আছে, এর প্রভাবে সে দাও (পথ) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে, এবং নষ্ট করতে পারে জাগতের নান্দনিক ভারসাম্যের ছন্দ। দাও-এর ছন্দে জীবনকে যাপন করাই হল পূর্ণতার জীবন। কিন্তু লাও জু বলেন, দাও-কে অনুসরণ করা সহজ বিষয় নয়। দাও-কে নিয়ে কথা বলা, চিন্তা করা সম্পূর্ণ অর্থহীন। কারণ দাও হল তা মনুষ্য মন যা তার কল্পনায়ও আনতে পারে না। দাও-এর বৈশিষ্ট্য হল ‘উ’ (কিছু-না-হওয়া)। আর ‘উ উয়েই’ (কিছু-না-করা) হল দাও-এর ছন্দে বাঁচার একমাত্র পন্থা। লাও জু’র মতে, এই কিছু-না-করা মানে অলস হয়ে বসে থাকা নয়, বরং সবকিছুই করা প্রকৃতির ছন্দে—সজ্ঞায় এবং—স্বতঃস্ফূর্তভাবে। যার অর্থ হল, জীবনকে যাপন করা কোন আকাঙ্ক্ষা ছাড়া, লক্ষ্য ছাড়া—অথবা সমাজের ধরাবাঁধা নিয়মের তোয়াক্কা করা ছাড়া।

অনুবাদ ।। শরিফুল ইসলাম
মূলঃ দ্যা ফিলসফি বুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *