মন্টেইনঃ খ্যাতি আর মানসিক প্রশান্তি কখনই শয্যাসঙ্গী হতে পারে না

মন্টেইন তার প্রথমদিককার লেখা প্রবন্ধ ‘অন সলিটিউড’-এ জনপ্রিয় প্রাচীন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন, সেটা হলঃ অন্যদের ভিড়ে বাঁচার নৈতিক এবং বুদ্ধিগত বিপদ, এবং নির্জনতার মূল্য। নির্জনতার কথা বলতে গিয়ে মন্টেইন শারীরিক নির্জনতার উপর জোর দেননি, বরং আপামর জনগণের মতামত আর কর্মকাণ্ডে নির্বোধভাবে নিজেকে ছেড়ে দেয়ার আকর্ষণীয় লোভকে সংযত করার ক্ষমতা অর্জনের কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন তিনি। অন্য মানুষের সমর্থন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে তিনি বৈষয়িক সম্পদ আর সাম্পত্তি পাওয়ার অতি মোহের সাথে তুলনা করেছেন। মন্টেইন দাবি করেন যে, এই দুটো আসক্তিই আমাদেরকে নিঃশেষ করে দিতে পারে, কিন্তু তার মানে এই না যে এগুলোকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করতে হবে। আমাদের উচিৎ এগুলো থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব কিংবা নিরাসক্তি তৈরি করা। এতে করে—আমরা এগুলোকে উপভোগ করতে পারবো, এমনকি এগুলো থেকে উপকৃতও হতে পারবো, কিন্তু কিছুতেই আমাদের আবেগ সম্পদ কিংবা অন্যদের সমর্থন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার দাসে পরিণত হবে না কিংবা এগুলোর কোনটা হারিয়ে গেলে আমরা বিধ্বস্ত হয়ে পড়বো না।

তারপর, গণহারে মানুষের সমর্থন পাওয়াটা কীভাবে প্রসিদ্ধি লাভ অথবা খ্যাতির পেছনে ছোটার সাথে সংযুক্ত সেটার উপর আলোকপাত করা হয় এই প্রবন্ধে। মন্টেইনের পূর্ববর্তী চিন্তক নিকোলো ম্যাকাইভেলি বলেছিলেন, জীবনে প্রসিদ্ধি লাভের ব্যাপারটা একটা মানুষের যথাযোগ্য লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। মন্টেইন ঠিক তার উল্টো সুরে বললেন, খ্যাতি অর্জনের অবিরত চেষ্টা মানুষের মনের প্রশান্তি অর্জনের পথে সবচাইতে বড় বাঁধা। তিনি আরও বলেন, যারা প্রসিদ্ধি লাভকে একটা আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করে, তাঁরা কেবল তাদের হাত-পাগুলোকে ভিড়ের বাইরে রাখতে পারে, কিন্তু তাদের আত্মা আর তাদের ইচ্ছাশক্তি ভিড়েই আটকে যায় চিরতরে।

প্রসিদ্ধি লাভের পেছনে ছোটা উচিৎ কি উচিৎ না সেটা নিয়ে মন্টেইনের তেমন মাথাব্যথা নেই। তার কথা হল—অন্য মানুষের চোখে প্রসিদ্ধি লাভের আকাঙ্ক্ষাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে—নিজের মূল্য নির্ধারণে নির্ভর করা যাবে না অন্যের প্রশংসা আর সমর্থনের উপর। চারপাশের লোকজনদের সম্মতি খোঁজার পরিবর্তে আমাদের উচিৎ এটা কল্পনা করা যে, একটা সত্যিকারের মহৎ সত্তা সবসময়ই আমাদের সাথে আছেন—যিনি আমাদের সবচাইতে গোপন চিন্তাটাও পর্যবেক্ষণ করেন, তিনি এমন এক সত্তা যার উপস্থিতিতে একটা পাগলও তার ব্যর্থতা লুকিয়ে রাখতে চায়। এভাবে দেখলে, আমরা আরও পরিষ্কার ভাবে এবং নৈর্ব্যক্তিক ভাবে চিন্তা করতে পারবো এবং আরও চিন্তাশীল এবং যৌক্তিক উপায়ে আচরণ করতে পারবো। মন্টেইনের দাবি, অন্যের মতামতকে খুব বেশি গুরুত্ব দিলে আমরা তখন নষ্ট হয়ে যাই—হয় যারা খারাপ তাদেরকে অনুকরণ করতে গিয়ে এটা হয় অথবা তাদের প্রতি আমাদের এত ঘৃণা, যা গিলে খেয়ে ফেলে আমাদের চিন্তার মূল শক্তিকে।

খ্যাতি লাভের ফাঁদ

মন্টেইন তার শেষেরদিককার প্রবন্ধগুলোতেও খ্যাতি লাভের পেছনে ছোটার আকাঙ্ক্ষার উপর আক্রমণ চালান। তিনি বলেন, খ্যাতি অর্জনের ব্যাপারটা এতটাই দৈবাৎ যে এটাকে নিষ্ঠার সাথে ধরে রাখার খুব বেশি যৌক্তিকতা নেই। তিনি লেখেন, “আমি কত দেখেছি, সৌভাগ্য মেধারও আগে আগে হাঁটে এবং সেটা অনেকটাই আগে।” তিনি আরও বলেন, খ্যাতির জন্য রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে গুরুত্ব দেওয়া, যেমনটা দিয়েছিলেন ম্যাকাইভেলি, এর অর্থ হল—যতক্ষণ না দর্শক-শ্রোতা থাকবে, ততক্ষণ কোন প্রচেষ্টায় নামা বৃথা—অর্থাৎ, কী লাভ যদি না তাদের এই লক্ষণীয় ক্ষমতা এবং অর্জনকে দেখে হাততালি দিয়ে উঠার মত কোন দর্শক তৈরি হয়ে না থাকে।

অনুবাদ ।। শরিফুল ইসলাম
মূলঃ দ্যা ফিলসফি বুক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *