খ্রিস্টপূর্ব ৮-৬ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের দিকে গ্রিসের উপদ্বীপবাসীরা ধীরে ধীরে শহর-নগরে বসতি শুরু করে দিয়েছিলো। তৎকালে তারা বর্ণানুক্রমিক লেখার একটি পদ্ধতি তৈরি করেছিলো, যার সাথে সাথেই খুলে গিয়েছিলো দর্শন-জগতের এক মহাদরজা যা আজকে আমাদের কাছে পশ্চিমা দর্শন নামে পরিচিত। এর আগের বিদ্যমান সভ্যতাগুলোর কাছে তাদের চারপাশের ঘটনা-দুর্ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করার একমাত্র ভরসা ছিলো ধর্ম। সেখানে এখন আবির্ভাব ঘটলো একদল নতুন চিন্তকের, যারা মত্ত হয়েছিলো ধর্মীয় অলৌকিকতাকে ছাড়িয়ে সবকিছুর প্রাকৃতিক ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টায়।
এইসব নতুন বৈজ্ঞানিক চিন্তকদের মধ্যে যাকে আমরা ভালো করে চিনি তিনি হলেন থেলিস মিলেটাস। তার লেখালেখির কোন কিছুরই এখন আর অস্তিত্ব নাই, কিন্তু আমরা জানি জ্যামিতি এবং জ্যোতির্বিদ্যায় তার কতটা ভালো দখল ছিলো এবং ৫৮৫ খ্রিস্টপূর্বে তার করা একটা পূর্ণাঙ্গ সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যৎবাণী তার খ্যাতিকে তুলে দিয়েছিলো তুঙ্গে। নিজের মনের এই ব্যবহারিক পরিবর্তন দেখে থেলিস বিশ্বাস করতে শুরু করলো যে পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার পেছনে ঐশ্বরিক কোন শক্তি কোনকালেই কাজ করেনি, বরং সবকিছুর পেছনেই ছিলো প্রাকৃতিক কারণ যার রহস্য যুক্তি এবং পর্যবেক্ষণের সাহায্যে উন্মোচন করা সম্ভব।
মৌলিক পদার্থ
নিজের দার্শনিক যাত্রায় প্রথম প্রিন্সিপ্যালটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য থেলিস যে প্রশ্নটি দাঁড় করালো সেটা হলো, “ব্রহ্মাণ্ডের মৌলিক উপাদানটি কী?”, অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ড কীসের তৈরি? চূড়ান্তভাবে পুরো ব্রহ্মাণ্ডের সকলকিছুকে একটা একক উপাদানে সংকুচিত করা সম্ভব, থেলিস এবং তার অনুসারীদের এমন একটি চিন্তার উপর ভর করে পশ্চিমা দর্শনে পত্তন ঘটলো মনিজম তথা অদ্বৈতবাদের।
থেলিসের মতে, মহাবিশ্বের মৌলিক উপাদানটি এমন একটা কিছু যা থেকেই গঠিত হয়েছে সকল বস্তু, পাশাপাশি এটা সকল প্রাণের উৎস এবং অবশ্যই এটা গতিশীল, অতএব পরিবর্তনশীল। তিনি দেখলেন যে সকল ধরণের প্রাণের টিকে থাকার জন্য যেটা পরিষ্কারভাবে দরকারি সেটা হলো পানি, এবং পানি হলো গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল, একেক সময় তার একেক রূপ – তরল, কঠিন এবং বায়বীয়। এর থেকে থেলিস এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে সকল বস্তু, আপাত রূপ সেটার যেরকমই হোক না কেন, রূপান্তরের কোন এক ধাপে সেটা অবশ্যই পানি ছিলো।
থেলিস আরও দেখলেন যে পৃথিবীর প্রতিটা ভূখণ্ডই শেষ হয় পানিতে গিয়ে। সুতরাং তিনি বলতে লাগলেন যে পৃথিবীটা বিশাল এক জলরাশির বিছানায় ভাসছে যার উদর থেকেই উৎপত্তি হয়েছে পৃথিবীর। এই জলরাশিতে যখন কোন বুদবুদ কিংবা কাঁপুনি দেখা দেয়, সেটাকেই আমরা ভূমিকম্প হিসেবে অনুভব করি।
যাইহোক, থেলিসের থিওরিগুলোর বর্ণনাসমূহ যতই কৌতূহলোদ্দীপক হোক না কেন, দর্শনের ইতিহাসে একজন অন্যতম ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পেছনে তার এইসব থিওরিই প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করে নাই। বরং প্রকৃতির সকল ঘটনাকে খেয়ালী ঈশ্বরের খামখেয়ালী সৃষ্টি হিসেবে মেনে না নিয়ে এগুলোকে প্রাকৃতিক এবং যৌক্তিক পন্থায় ব্যাখ্যা প্রদানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম চিন্তক হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে থেলিসের গুরুত্ব। এর উপর ভর করেই সে এবং মাইলসিয়ান স্কুলের পরবর্তী দার্শনিকরা প্রতিষ্ঠা করেছিলো পুরো পশ্চিমা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক চিন্তার ভিত্তি।
অনুবাদ ।। শরিফুল ইসলাম
মূলঃ দ্যা ফিলসফি বুক