জনপ্রিয়তা, স্টুপিডিটি আর ইন্টেলেক্ট

সাহিত্য, সিনেমা কিংবা অন্য যে-কোন আর্টওয়ার্ক সৃষ্টিকারীরা প্রধানত দুই ভাবে কাজ করে কিংবা বলা যায় দুই দলে কাজ করে। এর মধ্যে একদল হলো যারা সাধারণ মানুষের এক্সিসটিং রুচিকে স্যাটিসফাই করে শিল্পকর্ম করে। এতে তাদের কর্ম বহুসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছায়। মানুষ তাদের লেখা পড়ে কিংবা সিনেমা দেখে গণহারে। তাদের কর্ম জনপ্রিয়তা পায়। এর একটা কারণ, এইসব শিল্পকর্মের সাথে সাধারণ মানুষ নিজেকে কানেক্ট করতে পারে। আর আরেকটা কারণ—যেটা প্রধানতম—সেটা হল, সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের ডিফল্ট সেট-আপটাই আসলে অলসতা প্রবণ। বেশিরভাগ মানুষের মস্তিষ্কই কোন কঠিন কিংবা গভীর চিন্তা দিয়ে নিজেকে এক্সস্ট করতে চায় না। এরা ইন্টেলেকচুয়ালি অলস। তাই তারা এমন কিছু পড়তে এবং দেখতে চায়, যা পড়তে কিংবা দেখতে গেলে মস্তিস্কে কোন প্রকারের চাপ সৃষ্টি হয় না। অর্থাৎ, মানুষ সাধারণত ‘প্রোন টু বি স্টুপিড’।

আর্টওয়ার্ক সৃষ্টিকারী অন্য আরেকটা দল হলো তারা, যারা সাধারণ মানুষের কিংবা সমাজের অথোরিটির এক্সিসটিং রুচিকে স্যাটিসফাই বা প্রথাগত চিন্তার প্রবাহকে তরান্বিত করার জন্য তাদের শিল্পকর্ম করে না। বরং তারা নিজের চিন্তাকেই—যা সবসময়ই হয় আনকনভেনশনাল—তুলে ধরে তাদের কর্মে। যেহেতু এইসব কর্ম সাধারণের এক্সিসটিং রুচিকে চ্যালেঞ্জ করে এবং তাদের মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে, তাই তাদের বেশীরভাগ কর্মই জনপ্রিয়তা পায় না। এই জনপ্রিয়তা না পাওয়া মানে এই না যে মানুষ এইসব কর্মের কোন খবরই পায় না। পায়, কিন্তু সেটা পড়ে না কিংবা দেখে না। আবার কিছু বড় বড় কর্ম আছে যেগুলো নিজস্ব কিছু ফিচার, সময়, এনডরসমেন্ট, যেমন—অস্কার অথবা নোবেল পুরস্কারের মত অথোরিটির স্বীকৃতি পাওয়ার কারণে—যেমন, মুভি ফরেস্ট গাম্প, ম্যাট্রিক্স, মার্কেজের বই নিঃসঙ্গতার একশো বছর, লালনের গান ইত্যাদি—এগুলো এক ধরনের জনপ্রিয়তা পায় ঠিকই, কিন্তু সেখানে সাধারণের মস্তিষ্ক খরচ হয় না তেমন। অর্থাৎ, সাধারণরা এইসব ফ্যাশনিবলি পড়ে কিংবা দেখে, কিন্তু কর্মের মূল এসেন্সটা ধরতে পারে না। তবে সমাজের কালেক্টিভ চিন্তা-চেতনার মূল ধারায় এইসব কাজের প্রভাব পড়তে থাকে ধীরে ধীরে।

প্রথম দলের জনপ্রিয় সাহিত্য বা শিল্পকর্মকে অনেকেই আল্টিমেট সফলতা হিসেবে ধরে নেয়। এর কারণ হিসেবে তারা সাধারণ মানুষের রুচিকে তথা মনকে ছুঁতে পারার ক্ষমতাকে ইঙ্গিত করে। তাদের মতে, যেসব কাজ সর্ব সাধারণের কাছে বোধগম্য না, সেসব কাজ ব্যর্থ। কিন্তু এখানে মজার বিষয় হল, এইসব জনপ্রিয় সাহিত্য কিংবা সিনেমা মানুষের ডিফল্ট জং ধরা রুচিকে জং ধরা হিসেবেই লালন করার ক্ষেত্রে সাহায্য করে। এখানে চিন্তার পরিবর্তন ঘটে কদাচিৎ। এখন প্রশ্ন হল, এইসব জনপ্রিয় সাহিত্যে বা সিনেমায় আসলে কী থাকে? রিয়েলিস্টিক কিছু যার সাথে মানুষ সহজে নিজেকে কানেক্ট করতে পারে? উত্তর হল, না। এটাই সবচাইতে ট্রিকি পার্ট। যেমন, ইমদাদুল হক মিলন, হুমায়ূন আহমেদ কিংবা সাদাত হোসাইন এর মত লেখকদের সাহিত্য কিন্তু আমাদের সমাজের এক্সাক্ট চিত্র তুলে ধরে না, আবার পরাবাস্তব কিছু চিত্রায়িত করেও রিয়্যালিটি জ্ঞাপন করতে চায় না, তবুও এগুলো জনপ্রিয়। কারণ, এগুলো মানুষের মস্তিষ্কের অলসতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এক ধরনের টুইস্ট আর থ্রিল প্রদান করে মুখরোচক বিনোদন যোগায়, যা পুরোপুরি বাস্তব না, অবাস্তবও না।

দ্বিতীয় ক্যাটাগরির আনকনভেনশনাল সৃষ্টিশীলদের মধ্যে আবার আরেকটা দল আছে, যারা তাদের কর্মে সমাজের এক্সাক্ট চিত্রটা তুলে ধরে। সূত্রানুসারে, এইসব সৃষ্টির সাথে সাধারণ মানুষ নিজেকে খুব কানেক্ট করতে পারার কথা এবং তা জনপ্রিয় আর প্রশংসিতও হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয় না। কারণ, নিজের সমাজের একদম ন্যাংটা চিত্র দেখলে সাধারণ মানুষ আবার সহ্য করতে পারে না। যেমন, হেনরি ফিল্ডিং-এর বই ‘টম জোনস’, গোস্তাব ফ্লভে-এর লেখা বই ‘ম্যাডাম বোভারি’ পাবলিশ হওয়ার পর লেখকদেরকে অশ্লীলতার দায়ে সমাজের তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল, এমনকি কোর্টেও উঠতে হয়েছিল। এ ব্যাপারে হেনরি ফিল্ডিং বলেছিলেন, সমাজে যদি যৌনতা থাকে, তাহলে আমি কী করবো? আমি কি অন্য কিছু লিখবো?

সাধারণের রুচিকে ফিড করে এমন সাহিত্য কিংবা সিনেমা বানানো কি সমস্যা? এক্সিসটেনশিয়াল পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখলে কোন সমস্যা নাই। মানুষ কী পড়ে মজা পাবে, কী দেখে পুলকিত হবে এবং কী চর্চা করে জীবনকে যাপন করবে তাতে আলটিমেটলি কারও কিছু আসা যাওয়ার কথা না। যার যা ভালো লাগে তা করুক না। কোন কিছুতেই কোন সমস্যা নাই। তাছাড়া, জনপ্রিয় সাহিত্য আর সিনেমা মানেই তো নেতিবাচক কিছু না। মস্তিষ্কের রিলাক্সেশনে এগুলো উপাদান হিসেবে কাজ করতেই পারে। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধে ব্যাপারটাকে আপাত রিয়্যালিটির পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখলে। আপাত রিয়্যালিটি বলতে আমাদের ভালো-মন্দ, সাদা-কালো’র বিচারে চলা কন্ডিশনাল গোল অরিয়েন্টেড রিয়্যালিটির কথা বোঝাচ্ছি। এবং আমরা যেহেতু এই রিয়্যালিটিতেই নিজেদেরকে দেখতে পাই, তাই এখানে শিল্পকর্মে সিরিয়াসনেসের ব্যাপার চলে আসে। এখানে জনপ্রিয় সস্তা সাহিত্যের চেয়ে সমাজের কনভেনশনাল চিন্তাওয়ালা মাথায় হাতুরি পেটা করার মত সাহিত্যকর্ম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। আর যদি না হয়, তাহলে জনপ্রিয়তার শিল্পকর্ম কনজিউম করে করে মানুষের স্টুপিডিটি থেকেই যায়—ইনট্যাক্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *