আবু কাউছারের স্বর্গ

রাত এগারোটা কি বারোটা হবে। বারোটা হলেই বোধহয় সুবিধে। ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা ঘটার জন্য একটা উপযুক্ত সময়। স্ট্রিট ল্যাম্পের নিঃসঙ্গ আলোটা অথবা এটা চাঁদের আলোও হতে পারে—কারণ তখনো শহরে দৈত্যাকার দালানগুলোর মাথা ডিঙিয়ে চাঁদটা নিজের একাকীত্ব বিছিয়ে দিতে নেমে আসতো পিচঢালা রাস্তাগুলোতে, কাঁচ ভেদ করে উঁকি দিত দিবসের ক্লান্তিতে ঝিমুনি ধরা সেলুন কিংবা বন্ধকীর দোকানে—লাল রঙের বর্ডার দিয়ে আধা ইঞ্চি পুরো কাঁচের দেয়ালে সাদা রঙে লেখা নামের বড় বড় অক্ষরের ফাঁক গলে আলোটা ঢুকে পড়েছে মহাজন বিশ্বজিৎ মণ্ডলের বন্ধকীর দোকানটায়। বিশ্বজিৎ মণ্ডল দোকানেই আছেন। তবে স্ট্রিট ল্যাম্প কিংবা চাঁদের আলোয় দেখা যাচ্ছে যে তিনি চিৎ হয়ে পড়ে আছেন মেঝেতে। তার পরিষ্কার টাক, ফর্সা মুখের উপর পাকা চাপদাড়ি আর গায়ের মেরুন রঙা কোটের সাদা বোতামগুলো এই মৃদু আলোয় একটা উজ্জ্বল আভা ছড়াচ্ছে। চেতন আর অচেতনের মাঝখানে বোবায় ধরা ঘুমন্ত মানুষের মত একটু পরপর নড়ে উঠছে তার দক্ষিণমুখী মাথাটা, সাথে তাল মিলিয়ে লাফিয়ে উঠছে তার বুকটাও। বিশ্বজিৎ মণ্ডল কি ঘুমুচ্ছেন? না। তাঁর এখন আহতাবস্থা। কোন রক্তপাত নাই যদিও। ঘাড়ে কিংবা মাথায় শক্ত আঘাত পেয়েছেন বলে মনে হয়। পাশেই দেখা যাচ্ছে একটা ছোট কাঠের টুলের উপরে তিন-ব্যাটারির একটা টর্চ লাইট, তার পাশে একটা মোটা কাগজের ব্যাগ। টুলটার মালিক বিশ্বজিৎ মণ্ডল হলেও ব্যাগ কিংবা তিন-ব্যাটারির টর্চ লাইট কোনটাই তার না। এগুলোর মালিক আবু কাউছার। আবু কাউছার একজন ডাকাত। ছোটবেলায় বন্ধুরা নাম ব্যাঙ্গ করে তাকে ডাকতো কাউয়া বলে। সেও নিজেকে মনে মনে কাক ভাবতেই সাচ্ছন্দ বোধ করতো, এখনও করে। পুকুরে গোসলে নেমে ডুব দিতে গেলেই কাক যেমন ছোঁ মেরে সাবানদানীর সাবান নিয়ে উধাও হয়ে যায়, সেই স্বভাব বাল্যকাল থেকেই আবু কাউছারের মধ্যে ফুটে উঠতে থাকে চুরি আর ছিনতাইয়ের ছোট ছোট ঘটনার মধ্য দিয়ে। এখন সে প্রাপ্ত বয়স্ক ডাকাত। কোমরে একটা পিস্তল গুঁজা থাকে সবসময়। কাকের মত ছোঁ মেরে মেরে আর পুলিশের তাড়া খেয়ে খেয়ে যৌবনের প্রথম বছরগুলো উদ্যমে কাটলেও, ইদানিং এই দৌড়াদৌড়িতে বড্ড ক্লান্ত লাগে তার। কিন্তু কী করা, এই একটা কাজ ছাড়া আর কোন কিছুই জানা নাই আবু কাউছারের। পিস্তলের বাট কিংবা ভারি কিছু একটা দিয়ে মহাজন বিশ্বজিৎ মণ্ডলের ঘাড়ে কিংবা মাথায় শক্ত আঘাত করেছে সে। বন্ধকীর দোকান—লোকজনের বন্ধক রাখা সোনাদানা, ঘড়ি, ক্যামেরা, টেলিভিশন ইত্যাদিতে ভরপুর। তার কাজটা যেহেতু বরাবরই তাড়াহুড়ার, তাই সোনাদানা আর অলংকারেই সন্তুষ্ট হয়ে কাজ সারতে মোটা কাগজের ব্যাগটা নিয়ে এসেছে সে। টর্চ লাইট টিপে টিপে তাকের ছোট ছোট বাক্সে রাখা সোনাদানাগুলো ব্যাগে ভরে যাচ্ছিলো দ্রুত। একটা বাক্স থেকে জিনিসগুলো ব্যাগে পুরতে গিয়ে আনমনে কারও বন্ধক রেখে যাওয়া একটা আংটি হাতে নিয়ে চেপে ধরেছে দুই ঠোঁটের মাঝখানে। বাক্সটা খালি হয়ে গেলে আংটিটা বাম হাতের গ্লাভস খুলে অনামিকায় পড়ে ঠিকঠাক লাগে কিনা পরীক্ষা করতেই আবু কাউছারের কানে বাজলো অতি পরিচিত পুলিশের গাড়ির সাইরেনের আওয়াজ। ব্যাগ আর টর্চ লাইটটা হাতে নিয়ে কোন ভয় কিংবা আতঙ্ক ছাড়া অতি মাত্রায় সজাগ একটা ব্যাঙের মত লাফিয়ে পালানো শুরু করলো সে। দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই পুলিশের গাড়িটা চলে এসেছে একদম কাছে। পরিচিত পুলিশের পরিচিত দাবড়ানিতে পরিচিত গতিতে দৌড়ে গোত্তা মেরে সে ঢুকে পড়লো দৈত্যাকার দালানগুলোর মাঝখানের এক প্রশস্ত গলিতে। গলির শেষ মাথায় একটা কাঠের দেয়াল। গলিটা চাঁদের আলোর মৃদু প্লাবনে ভাসতে থাকলেও আলোটা দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে নাই। তাই জায়গাটা অন্ধকার। এক লাফে দেয়ালে ঝুলে পড়ে সেটা টপকানোর চেষ্টা চালাতেই পুলিশের টর্চের আলোটা পেরেক ঠুকে যেন দেয়ালে আটকে দিল তাকে। সোনাদানায় ভরা ব্যাগটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেছে আগেই। পুলিশ বললো, থামো, নয়তো গুলি করবো। কোমর থেকে পিস্তল বের করে এক হাতে দেয়াল ধরে আরেক হাতে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পুলিশের উদ্দেশ্যে বহুকালের পরিচিতের মত আবু কাউছার বলে উঠলো, এইবেলা না, চুদির ভাইয়েরা! দুইটা গুলি ছুড়ে দেয়ালটা টপকানোর চেষ্টায় বাম পা উঠিয়ে ডান পা টেনে তুলতেই কালো জ্যাকেট ভেদ করে তার পিঠে এসে বসলো পুলিশের তিন-তিনটে গুলি, আরেকটা লাগলো তার মাথায়। মাটিতে ছিটকে পড়ে মহাজন বিশ্বজিৎ মণ্ডলের মত চিৎ হয়ে দক্ষিণমুখী মাথাটা নাড়তে নাড়তে জীবনভর দৌড়ের উপর থাকা কাউয়া চরিত্রের খ্যাপাটে আবু কাউছার ভেবেছিল এই বুঝি তার জীবনব্যাপী দৌড়ের সমাপ্তি ঘটলো। কিন্তু হায়, এটা যে কেবল শুরু।

আধ ঘণ্টা অথবা এক ঘণ্টা কিংবা দুই ঘণ্টা পর, যখন আবু কাউছারের দক্ষিণমুখী অচেতন দেহটার সামনের অংশটা দেখা যাচ্ছিলো চাঁদের আলোয়, যেখানে পেছনের অংশে দেয়ালের দিকটায় আলো পৌঁছায়নি, এক ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন তার মাথার কাছে এসে। লোকটার পায়ের জুতা জোরা ধবধবে সাদা। পরনে ততোধিক সাদা এক প্যান্ট, কোমরে সাদা বেল্ট, গায়ে সাদা কোট, তার ভেতরে সাদা শার্টের উপরে ঘি অথবা ধূসর রঙের টাই, মুখে নাতিদীর্ঘ সাদা দাঁড়ি, সাদা গোঁফ, মাথায় আধো টাকের উপর এক গুচ্ছ সাদা চুল। আপাদমস্তক সাদা এই ভদ্রলোকের চেহারা দেখলে মনে হয় বয়স তার পঞ্চাশের ঘরে উঠানামা করছে গত দেড় দশক ধরে। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে শ্রদ্ধা মিশ্রিত মোলায়েম সুরে গলার স্বরটা একটু উঁচু করে তিনি ডাকতে লাগলেন, জনাব আবু কাউছার, জনাব আবু কাউছার বলে। বোবায় ধরা ঘুমন্ত মানুষ কিংবা বিশ্বজিৎ মণ্ডলের মত মাটিতে পড়ে থাকা দক্ষিণমুখী মাথাটা নড়ে উঠতে লাগলো আবু কাউছারের। ঘাড়টা কয়েক ধাপে সোজা করে সাদা ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আপনে কে? মুখে একটা স্থূল হাসি ঝুলিয়ে লোকটা উত্তর দিলেন, আমার নাম পিপ। বলেই বাড়িয়ে দিলেন হাতটা। আবু কাউছারের মুখ কুঁচকে উঠলো। এমন নাম সে জীবনে কখনো শুনেছে কিনা মনে করতে পারলো না। জিজ্ঞেস করলো, আপনে আমার নাম জানেন ক্যামনে? লোকটা বলল, আপনার সম্পর্কে সবকিছু জেনে রাখাই আমার প্রধান কাজ। চাকরি বলতে পারেন। সে পুলিশ কিনা জানতে চাইলো আবু কাউছার। না না, আমি কোন পুলিশ নই। আমি আপনার উপদেষ্টা, বললেন লোকটা। মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে আবু কাউছার বলল, উপদেষ্টা, হাহ! এখন আমার উপদেষ্টা-ফেস্টা না, নিজের মাথাটা ফুঁটা করতে পারলেই মনে হয় ভালো লাগতো।

লোকটার বাড়ানো হাত ধরে উঠে দাঁড়ালো সে। দাঁড়াতেই ঝিমঝিমিয়ে উঠলো মাথাটা, তাল হারিয়ে পড়লো গিয়ে পেছনের এক প্লাস্টিকের ডাস্টবিনের উপর। লোকটা তাকে আবার টেনে দাঁড় করানোর চেষ্টা চালাতেই আবু কাউছার হাতটা ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞলে করলো, কী হইছিলো আমার?

আপনার একটা ছোটখাটো একসিডেন্ট হয়েছিলো। কিন্তু চিন্তা করবেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি ঠিক একটা নতুন বেহালার মত টানটান হয়ে উঠবেন। আমার মনে হয় আপনি খুব দ্রুত গায়ের এই নোংরা জামা কাপড়গুলো পাল্টাতে চান, তাই না জনাব আবু কাউছার?

আবু কাউছার পূর্বের চেয়ে গলা একটু চড়া করে আবার জানতে চাইলো সে কীভাবে তার নাম জানলো সেই কথা।

আমি তো বললাম। আপনার সম্পর্কে সবকিছু জানাই আমার কাজ।

আরে ধুর মিয়া! ফাইজালামি করেন নাকি? দেখেন, ডাকাতির স্বভাব আমার, কিন্তু গেম খেলতে ভালো লাগে না।

না না, এটা তো ঠিক বলেননি জনাব আবু কাউছার। পকেট থেকে ছোট একটা নোটবুক বের করে পাতা উল্টে লোকটা পড়ে শোনাতে লাগলো কী কী খেলা আবু কাউছার ছোট বেলায় পছন্দ করতো। দশ থেকে তের বছর বয়সের মাঝামাঝি সময়ে তার যে ডাংগুলি খেলা খুব প্রিয় ছিল সেটাও জোর গলায় উল্লেখ করলো লোকটা।

হাত থেকে টান দিয়ে নোটবুকটা নিয়ে কয়েক পাতা উল্টে পাল্টে দেখে আবু কাউছার জিজ্ঞেস করলো, কী চান আপনে আসলে বলেন তো!

শুধু একটা জিনিসই চাই জনাব আবু কাউছার। আপনার আরাম-আয়েশ। আমার কাজ হল আপনি যা চান, সেটা যাই হোক, ঠিকঠাক মত পান কিনা তা দেখা।

তাই নাকি? তো এর বদলে আপনে কী পাইবেন?

কিছুই না জনাব আবু কাউছার। একেবারেই কিছু না।

আমারে রাগাইয়েন না, মিয়া! এই জগতে কেহই ফ্রিতে কিছু করে না! ইতরে ভরা এই দুনিয়ায় আমি যাই পাইছি সবই আমারে ছিনাইয়া নিতে হইছে। আমারে বুঝাইতে আইসেন না! কী চান সেইটা কইয়া ফালান। আপনার কোন কাজ কইরা দেওয়া লাগবে, সেইজন্যে আসছেন, তাই না?

ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লোকটা বললেন, আপনি দেখি আমার কথা কিছুই বুঝতে পারছেন না।

আবু কাউছার এবার একটু গরম হয়ে কোমরের পিস্তলটা খুলে নলজোরা লোকটার সাদা ভুরিটার উপর ঠেকিয়ে বলল, মানি ব্যাগ বাইর করেন!

লোকটা হাসতে হাসতে বললেন, আমার কোন মানি ব্যাগ নাই।

মানি ব্যাগ নাই মানে!

আচ্ছা, দাঁড়ান দাঁড়ান। আপনি তো আসলে আমার মানি ব্যাগ চান না, আপনি চান টাকা। বলেই সাদা প্যান্টের দুই পকেট থেকে দুই হাতে কতগুলো চকচকে নোট বের করে আবু কাউছারের মুখের সামনে ধরে নাড়াতে লাগলেন লোকটা। খপ করে টাকাগুলো হাতে নিয়ে গুনতে লাগলো আবু কাউছার, পাঁচশ, এক হাজার, দুই হাজার, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ হাজার টাকা! চোখ দুইটা চকচক করতে লাগলো আবু কাউছারের।

এই মুহূর্তের জন্যে এই টাকাটাই যথেষ্ট, তাই না, জনাব আবু কাউছার?

মানে কী, আপনার কাছে আরও টাকা আছে নাকি? উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেল করলো সে।

অবশ্যই। আপনি যত টাকা চান, তত টাকাই আছে আমার কাছে। এখন দয়া করে চলুন আমার সাথে।

লোকটার মতলব কী আবু কাউছার ঠিক আচ করতে না পারলেও টাকার গন্ধে হোক অথবা তার হাতে থাকা পিস্তলের ক্ষমতার বলে হোক অথবা কৌতূহলের বশেই হোক লোকটার সঙ্গে যেতে সে দ্বিধা করলো না। মুখে একটা কৃত্রিম শক্ত ভাব ধরে রেখে পিস্তলটা লোকটার পিঠে ঠেকিয়ে বললো, চলেন, উল্টাপাল্টা কিছু দেখলেই খবর আছে!

কারুকার্য মণ্ডিত এক উঁচু কাঠের দরজা খুলে লোকটা আবু কাউছারকে নিয়ে প্রবেশ করলেন একটা ঘরে। রাজকীয় ঘর। দেখে হকচকিয়ে গেলো আবু কাউছার। চোখে অবিশ্বাস নিয়ে দেখতে লাগলো ঘরের এপাশ ওপাশ। দৌড়াদৌড়ির এই ছোট জীবনে এমন রাজমহল সে আগে কখনও দেখে নাই। মেঝেতে মকমলের দামি কার্পেট, ঘর ভর্তি দামিদামি সব আসবাবপত্র। আপনার পছন্দ হয়েছে? জিজ্ঞেস করলো লোকটা।

নরম কার্পেট মারিয়ে ঘরের এমাথা-ওমাথা করতে করতে গলার স্বরটা একটু টেনে লম্বা করে আবু কাউছার জবাব দিল, ওরেব্বাস! সেই রকম তো! এই বাড়ি কার বলেন তো? নিশ্চয়ই কোন দুর্নীতিবাজ নেতার, তাই না?

কী বলেন! এটা আপনার বাড়ি জনাব আবু কাউছার। অবশ্য যদি আপনি চান আর কি।

দেয়ালে ঝুলানো শিল্প মণ্ডিত পাঁচ ইঞ্চি বর্ডারের তিন ফুটের মত লম্বা ফ্রেমে এক লাস্যময়ী নারীর পেইন্টিং এর উপর চোখ বোলাতে বোলাতে আবু কাউছার জবাব দিল, হ্যাঁ, আমি চাই তো।

যদি কোন কিছু আপনার অপছন্দ হয়, চাইলেই যে-কোন ধরনের পরিবর্তন আনা হবে এই বাড়িতে।

পেইন্টিং এর উপর থেকে চোখ না সরিয়েই আনমনে মাথা ঝাঁকালো আবু কাউছার।

উল্টোদিকের দেয়ালে ঝুলানো রঙিন পর্দার মাঝখানে আরেকটা লাস্যময়ী নারীর পেইন্টিং—অঙ্কিত নারীটা স্বল্পবসনা, মাথায় ময়ূরের পেখম— নিচেই পেতে রাখা বৃহদাকার এক মিউজিক প্লেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে কাচুমুচু ভঙ্গিতে লোকটা বললেন, আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে সঙ্গীতের এই হাই-ফাই সিস্টেমটা আপনার পছন্দ হবে কিনা।

ঘুরে এসে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য বিস্ময় নিয়ে প্লেয়ারের ঢাকনাটা উঠাতে উঠাতে আবু কাউছার বলল, আপনার কাজটা করে দিলে এই সবকিছুই আমি পাবো?

এই সবকিছুই আপনার। বলে লোকটা তাকে ডেকে নিয়ে দরজার বাইরে বাড়ির নেম-প্লেটটা দেখালো। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘আবু কাউছার’। দেখেছেন? এই নিন বাড়ির চাবি। চলুন আপনাকে প্রধান শোবার ঘরটা দেখাই।

আবু কাউছার আগ্রহী হয়ে তড়িঘড়ি করে শোবার ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে টের পেলো যে তার মনের সন্দেহটা এখনও কাটে নাই। থেমে গিয়ে পিস্তল ঠেকিয়ে লোকটাকে বলল, আপনে আগে ঢুকেন।

পুরো ঘরের মেঝের চাইতে পালঙ্ক রাখার জায়গাটা একটু বিশেষভাবে উঁচু। পালঙ্কের চারপাশের মেঝেটা আলাদা রঙের কার্পেটে ঢাকা, দেয়ালগুলোয় সুতোর কাজ করা বিশেষ পর্দা লাগানো। আবু কাউছারের বিস্ময় ঊর্ধ্বমুখী। বিছানাটায় বসে একটু দেখে নিলো সে।

এই পাশে গোসলখানা। আপনি বরং পরনের পোশাকটা পাল্টে একটু ফ্রেশ হয়ে নিন, বললেন লোকটা।

হ্যাঁ, সেইটাই করবো। কিন্তু তার আগে বলেন, আপনার ধান্দাটা কী? আমারে কী করা লাগবে এই সবকিছুর জন্যে?

দিব্যি বলছি, আপনার কিছুই করা লাগবে না।

ও বুঝছি। আপনে আসলে একটা গাড়ল। আপনে অন্য কারও আন্ডারে কাজ করেন, তাই না?

একভাবে বললে, তাই।

কই সে?

কে?

আপনার বস?

সেটা আমি বলতে পারবো না, জনাব।

ঠিক আছে। আমি তাইলে অপেক্ষা করি। বলে একটা সিঙ্গেল সোফায় গা এলিয়ে বাম পায়ের উপর ডান তুলে আরাম করে বসলো আবু কাউছার। ঘরের এক পাশে রাখা নানান রঙের পোশাকে ভর্তি আলামারিটা খুলে লোকটা বললেন, আপনার কোন রং পছন্দ জনাব আবু কাউছার? এই যে এটা। এটা বোধহয় আপনার ভালো লাগবে।

হ্যাঁ, এইটা খারাপ না।

হ্যাঙ্গার থেকে একটা টাই হাতে নিয়ে লোকটা বললেন, হলুদ নিশ্চয়ই আপনার প্রিয় রং।

ধুর মিয়া, আপনার তো কোন রুচি নাই দেখি। এইটা কোন টাই হইলো!

নিজে উঠে গিয়ে লাল শেডের একটা সাদা টাই হাতে নিয়ে আবু কাউছার বলল, টাই হইলো এইটা! আমি এইটাই পরবো।

গোসল শেষে ফুলবাবু সেজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে উল্লাসে হাসতে লাগলো সে।

আপনাকে খুবই ভালো লাগছে দেখতে, মহাশয়।

হ্যাঁ, বলতেই হয় যে আপনার বসের পোশাকের রুচি অনেক ভালো।

পাশের ঘরে গিয়ে দেখা গেল টেবিলের উপর অনেক খাবার-দাবারের আয়োজন। আবু কাউছার অনেক ক্ষুধার্ত। তড়িঘড়ি করে সে বসে পড়লো খেতে। অতি যত্নের সাথে তার প্লেটে খাবার তুলে দিতে লাগলো লোকটা। খাবার মুখে তুলতে গিয়ে আবু কাউছারের সন্দেহটা আবার চাড়া দিয়ে উঠলো। আপনে আগে খান, তারপর আমি খাবো।

আমি তো খাই না। প্রায় দুই-তিনশো বছর হয়ে গেছে আমি কিছু খাই না।

মজা করেন, মিয়া! খাবারে বিষ আছে, তাই না?

না।

তাইলে আপনে একটু খাইয়া দেখান।

কিন্তু আমি খায় কীভাবে সেটা ভুলে গেছি।

বুঝতে পারছি। নতুন নতুন পোশাক পড়াইয়া, টাকার লোভ দেখাইয়া, তারপর আমারে বিষ খাওয়াইয়া মারতে চান, তাই না? খুব চালাক আপনে, না, খুব চালাক? বলেই আবু কাউছার লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে তার বুকে গুলি ছুড়লো দুইটা। কিন্তু গুলিতে কিছুই হল না লোকটার। মুখে স্থূল হাসিটা নিয়েই দাঁড়িয়ে রইলো সে।

অ, বুলেট প্রুফ ভেস্ট পরছেন দেখা যায়। বলে লোকটার মাথায় আরও দুইটা গুলি ছুড়লো আবু কাউছার। কিন্তু লোকটা আগের মতই দাঁড়িয়ে রইলো আর বলল, এসবের কোন দরকার নাই জনাব আবু কাউছার।

আরেকবার গুলি ছুড়ে যখন দেখল কিছুই হচ্ছে না, আবু কাউছার চিন্তায় পড়ে গেল। এতটুকু রেইঞ্জের মধ্যে গুলি মিস হওয়ার তো কথা না, কপাল কুঁচকে উঠলো তার। পিস্তলটা ঠিক আছে কিনা পরীক্ষা করতে গুলি ছুড়লো একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা স্ট্যান্ডিং ল্যাম্পের উপর। শব্দ করে ভেঙ্গে পড়লো ল্যাম্পটা। পিস্তল তো ঠিক আছে। এই প্রথম একটা ভয়ের থাবা এসে গ্রাস করতে লাগলো আবু কাউছারকে। কোনরকমে গিয়ে পাশের সোফায় বসে শুকিয়ে আসা গলাটা একটু ভেজানোর জন্য হাত বাড়িয়ে একটা হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেল সে। কী ব্যাপার! এই মদের পাত্র, গ্লাস, এইগুলা কোত্থেকে আসলো? একটু আগেও তো এইগুলা এইখানে ছিল না? কী হইতেছে এইসব! কোথায় আসলাম আমি?

একটু কাছে এগিয়ে এসে লোকটা জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা জনাব আবু কাউছার, আপনার কি মনে আছে আজকে যখন আপনাকে আমি বললাম যে আমি আপনার উপদেষ্টা, তখন আপনি বললেন যে আপনার আসলে উপদেষ্টা-ফেস্টা না, নিজের মাথাটা ফুঁটা করতে পারলেই মনে হয় ভালো লাগতো?

হ্যাঁ, মনে আছে তো।

সত্যি কথা বলতে কি, তার কিছুক্ষণ আগেই আপনার মাথা ফুঁটা হয়েছিল। বুলেটের ফুঁটা।

একটু বেগ পাওয়া লাগলেও অতি অল্প সময়েই আবু কাউছারের মনে পড়ে গেল পুলিশের গুলি খাওয়ার কথা। হ্যাঁ, তাই তো। তাইলে তো আমি মরে গেছি। আমি কি মৃত?

জী জনাব।

আচ্ছা। আমি যদি মরেই গিয়ে থাকি, তাইলে এইসব সুন্দর পোশাক, খাবারদাবার, শরাব…তার মানে তো আমি স্বর্গে আছি? একটা খুশির ঝিলিক দেখা দিল আবু কাউছারের মুখে। উত্তেজনা প্রকাশিত হতে লাগলো তার গলার স্বরে, তাইলে তো আমি স্বর্গে আসছি! আর তুমি হইলা গিয়া আমার ফেরেশতা, তাই না?

হ্যাঁ, এরকমই কিছু একটা বলতে পারেন।

আমি এখন যা চাই তাই পাব, যা চাই তাই! সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে আবু কাউছার বলতে লাগলো, আমি এখন লাখ দশেক টাকা চাই। সবগুলা পাঁচশো টাকার নোট! আর চাই একটা রমণী। সুন্দর রমণী। কত সুন্দর সেটা মুখের ভাষায় বোঝাতে না পেরে আবু কাউছার ইঙ্গিত করলো দেয়ালে ঝুলানোর স্বল্পবসনা নারীর পেইন্টিং দুটোর উপর। তারপর একটা ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো লোকটার দিকে, কই? টাকা আর মেয়ে কই?

ওই যে বড় ড্রয়ারটা টান দিন, ওখানেই আপনার টাকা।

ড্রয়ার খুলে আবু কাউছার দেখলো পুরো ড্রয়ারটা পাঁচশো টাকার নোটে ভরা। দশ লাখ টাকা! দুই হাত ভরে চকচকে নোটগুলো নিয়ে পুরো ঘরে উড়াতে লাগলো আবু কাউছার। এখন মেয়ে কই?

লোকটা ইঙ্গিত করলো হাই-ফাই সঙ্গীত প্লেয়ারটার দিকে। অলৌকিকতায় নিজ থেকেই খুলে গেল প্লেয়ারের ঢাকনাটা, চালু হয়ে গেল প্লেয়ারটা। বাজতে শুরু করলো সঙ্গীত। পেছন দিক থেকে দুটো কোমল হাত এসে জড়িয়ে ধরলো আবু কাউছারকে। হাত দুটো এক সুন্দরী রমণীর, ঠিক পেইন্টিং এর অঙ্কিত রমণীর মতই। নান্দনিক এক নৃত্যে মেতে উঠলো মেয়েটা। বিস্ময়ে মাথায় হাত দিয়ে আবু কাউছার বলতে লাগলো সে এবার নিশ্চিত যে সে স্বর্গেই এসেছে। তারপর নৃত্যে যোগ দিল সুন্দরীর সাথে, যেন এমন ছন্দময় এক মুহূর্তের জন্যই ধরণীতে জন্ম হয়েছিল আবু কাউছারের।

চার-পাঁচ জন সুন্দরী পেছনে নিয়ে দামি ক্যাসিনোতে লক্ষ লক্ষ টাকার বাজিতে জুয়া খেলা ছিল জীবিত আবু কাউছারের মনের গোপন শখ। স্বর্গে এসে সেটারই বাস্তব রূপ দেয়ার পালা। সেটাই করতে লাগলো সে। লক্ষ লক্ষ টাকা জিততে লাগলো জুয়ায়। উচ্ছ্বসিত আবু কাউছার টাকাগুলো ব্যাগে ভরে দিয়ে দিল তার সাথে থাকা কোন এক সুন্দরীকে। জুয়া খেলা শেষ হলে আনমনে গিয়ে একটা জ্যাকপট মেশিনে পয়সা ঢুকালো। মেশিনের হাতল টান দিতেই বের হয়ে এলো পয়সার এক আস্ত ঝর্না। এত আনন্দ, এত সুখ আবু কাউছার জীবনে কোনদিনই অনুভব করতে পারেনি কিংবা কল্পনায়ও সেটা চিন্তা করার সাহস করেনি। ললনাদের জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে খেতে ক্যাসিনো থেকে বেরিয়ে গেটে একজন সিকিউরিটিকে লাঠি ঘুরিয়ে হাঁটতে দেখে আবু কাউছারে মুডটা হালকা নষ্ট হয়ে গেল। সিকিউরিটির লোকটা তার থেকে লম্বা কিনা।

আপনাকে কি কোন কিছু বদার করছে জনাব আবু কাউছার? জিজ্ঞেস করলো তার উপদেষ্টা তথা ফেরেশতা লোকটা।

হ্যাঁ, এই লোকটারে দেইখা আমার বিরক্ত লাগতেছে। দেখো, একটু লম্বা হওয়াতে সে কি ভাব নিয়া হাঁটতেছে।

ফেরেশতা সিকিউরিটির লোকটাকে এক আঙুলের ইশারায় তাৎক্ষণিক বামন বানিয়ে দিল। এখন খুশি, জনাব?

অবশ্যই। খুশিতে ফেটে পড়লো আবু কাউছার। বামনটাকে ডেকে একটু অপদস্ত করে স্বাদ মেটালো। তারপর সুন্দরীদের নিয়ে চেপে বসলো একটা ঝকঝকা নতুন গাড়িতে। ঘরে এসে শোবার ঘরে রমণীদের ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আবু কাউছার তার ফেরেশতাকে বলল, তোমার সাথে একটু কথা আছে। কালকে আমি আমার কিছু পুরনো মরে যাওয়া বন্ধুর সাথে দেখা করতে চাই।

সেটা তো সম্ভব না জনাব আবু কাউছার।

কেন ওরা মরার পরে স্বর্গে আসে নাই?

ব্যাপারটা ঠিক এমন না জনাব আবু কাউছার। পুরো ব্যাপারটাই ব্যাখ্যা করা একটু কঠিন। আসলে এখানে যা কিছুই দেখতে পাচ্ছেন সবকিছুই হল আপনার ব্যক্তিগত প্রপার্টি। এগুলো বিশেষভাবে আপনার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।

তাইলে, এই যে মেয়েগুলা, ক্যাসিনোতে দেখা মানুষগুলা, এইগুলা সব কি ভুয়া? মানে এইগুলা কি সিনেমার প্রপসের মত?

হ্যাঁ, তা বলতে পারেন। এখানে সবকিছুই এমন, শুধু আমি আর আপনি ছাড়া।

একটু চিন্তিত হয়ে আবু কাউছার জানতে চাইলো, আচ্ছা বলেন তো। আমি কীভাবে স্বর্গে আসলাম? আমার তো এইখানে আসার কথা না। তার মানে জীবনে আমি এমন কোন একটা ভালো কাজ করছি, যার জন্যে আজকে এতকিছু পাইতেছি। কিন্তু সেই কাজটা কী? আমার তো এইরকম কিছুই মনে পড়তেছে না। এখন বলেন, কীভাবে আমি এইটা জানতে পারব? আমার জানার খুব ইচ্ছা।

অবশ্যই জানতে পারবেন, জনাব। আমাদের এখানে রেকর্ডরুমে আপনার আমলনামা জমা আছে।

চলো দেখি।

ঠিক মেঘের উপর উঠে গেছে এমন একটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো আবু কাউছার আর তার ফেরেশতা পিপ। সিঁড়ির শেষ মাথায় এক সারি লকার। একটা লকার থেকে একটা ফাইল বের করে লোকটা আবু কাউছারের হাতে দিল। ফাইলের গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘আবু কাউছার’। ফাইলটা খুলে পড়তে লাগলো সে—জন্মের পর ছয় বছর বয়সে সে খুন করেছিল একটা কুকুরের বাচ্চাকে, সাত বছর বয়সে চৌদ্দটা খেলনা চুরি করেছিলো একটা দোকান থেকে, আট বছর বয়সে সংগঠিত করেছিল একটা গ্যাং, নয় বছর বয়সে হানা দিয়েছিল একটা বাইসাইকেলের দোকানে…।

পড়তে পড়তে আবু কাউছার বিরক্ত হয়ে উঠলো, সব তো দেখি খারাপ কাজের রেকর্ড। মানে কী বুঝলাম না!

আপনার সব রেকর্ডই এখানে লেখা আছে জনাব আবু কাউছার।

আমার মনে হয় আপনাদের কোন ভুল হইতেছে।

না, ভুল হওয়ার কোন উপায় নাই।

কিন্তু আমি তো কিছু বুঝতেছি না। যাইহোক, বাদ দেন। এইসব নিয়া চিন্তা কইরা লাভ নাই। চলেন যাই।

এখন আপনি কী করতে চান জনাব আবু কাউছার?

দ্বিধান্বিত আবু কাউছার বলল, কী আর করবো। বুঝতেছি না। সুন্দরীদের সাথে ফুর্তি করবো কিছুক্ষণ। তারপর…আর কী করবো…বুঝতেছি না।

কোন কিছুর দরকার হলে টেলিফোনে জাস্ট শূন্য ডায়াল করবেন। আমি এসে হাজির হয়ে যাব, জনাব।

ঠিক আছে।

ক্যাসিনোতে আবারও জুয়া খেলায় মেতে উঠলো আবু কাউছার। প্রতিবারই জিতে যায় সে। দিন যত এগুচ্ছিলো, জেতার আনন্দটা প্রতিস্থাপিত হচ্ছিলো একঘেয়েমিতে। এক পর্যায়ে জেতার পর সে টাকাগুলো ফেলে রেখে যেতে শুরু করলো ক্যাসিনোতেই। প্রতিদিনের মতই জ্যাকপট মেশিনটাতে পয়সা দিয়ে হাতলটা টানলেই ঝরে পড়তে থাকে পয়সার ঝর্না। সেগুলো ক্যাসিনোর মেঝেতে ফেলেই চলে আসে সে। শোবার ঘরে সুন্দরীদের সাথে তাস খেলতে গেলেও জিতে যায় সে প্রতিবার। জিততে জিততে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আবু কাউছার। দাবড়িয়ে ঘর থেকে বের করে দেয় মেয়েগুলোকে। বিরক্তি ধরে গেছে। আনমনে একটা আপেল হাতে নিয়ে কামড় বসাতে গিয়ে টের পায় আপেলের স্বাদটাও বড় একঘেয়ে। কিছুক্ষণ বিলিয়ার্ড খেলার চেষ্টা করে। এক শট খেলেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠে তার। হাঁটুতে চাপ দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে বিলিয়ার্ড স্টিকটা। ভালো লাগছে না, কিছুই ভালো লাগছে না আবু কাউছারের। চোখ যায় টেলিফোনটার উপর। উজ্জ্বল মুক্তা দিয়ে বাঁধানো টেলিফোনটা। শূন্য চেপে ডাকতে যায় ফেরেশতা বেটাকে। ডায়াল শেষ হতে না হতেই পিপ এসে হাজির।

জী জনাব, বলুন। কী করতে পারি আপনার জন্য?

আঁতকে উঠে রেগে যায় আবু কাউছার, এইভাবে ভূতের মত আইসা আতকা হাজির হও ক্যান, মিয়া?

আপনার যা আজ্ঞা জনাব।

আমার আজ্ঞা! আমার আজ্ঞা! বালের আজ্ঞা!

কী হয়েছে জনাব আবু কাউছার?

কিছু হয় নাই। কী হইবো! কিছুই তো হইতেছে না! হইতেছে কিছু? বলে লাথি দিয়ে ছোট টেবিলটা উপড়ে ফেলল আবু কাউছার। আমার আর ভালো লাগতেছে না এইখানে! একঘেয়ে লাগতেছে সব!

কী বলছেন জনাব?

হ্যাঁ, বুঝতেছেন না আপনে? এইখানে কোন কিছুতেই কোন উত্তেজনা নাই।

কিন্তু আপনি যে জুয়া খেলেন প্রতিদিন? আমি তো ভেবেছি আপনি এটা খুব উপভোগ করেন।

হ্যাঁ, করি। কিন্তু প্রতিবারই যদি আমিই জিতি, তাইলে এই খেলার কোন মজা থাকে! এইটা কী আর জুয়া খেলা থাকে!

তাহলে আমি আপনার হেরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেই, জনাব?

দূর মিয়া! এইটাও তো তাইলে আমার ইচ্ছাতেই হইলো। একই তো কথা!

বুঝতে পেরেছি। আপনার আগের জীবনটা খুব মিস করছেন এখন তাই না?

একদম! এইটাই বলতে চাইতেছি।

তাহলে পাশেই একটা ব্যাংক আছে। আপনি চাইলে ওটাতে ডাকাতি করতে পারেন। নাকি জুয়েলারির দোকানে ডাকাতি করতে চান?

না, ব্যাংকই ঠিক আছে।

তাহলে তো হলই।

দাঁড়াও, মিয়া। আগে বলো, এই ডাকাতিতে আমার ধরা খাওয়ার কি কোন চান্স আছে?

অবশ্যই। যদি আপনি ধরা খেতে চান, তাহলে কেন নয়?

দূর বাল! তুমি তো বুঝতাছো না, মিয়া। আমি যেইটা চাই সেইটাই যদি হয় তাইলে এই ডাকাতি কইরা কী লাভ! আহাজারি করে উঠে আবু কাউছার।

একঘেয়েমির ভারে অসহ্য আবু কাউছারের পুরো অস্তিত্ব বিদ্রোহী হয়ে উঠে। কিন্তু কী করবে। ফেরেশতাকে এবার কাছে টেনে বসিয়ে সে বলতে লাগলো, দেখো, আমি আসলে স্বর্গে আসার মত মানুষ না। কোথাও কোন একটা ভুল হইছে। আমি জীবনে কোন ভালো কাজ করি নাই। আমার এইখানে আসার কথা না। আমার এইখানে ভালোও লাগতেছে না।

ভুল হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না জনাব আবু কাউছার।

গজগজ করে উঠলো আবু কাউছারের গলা, আর একটা দিন এইখানে থাকলে আমি উম্মাদ হইয়া যাব। আমি নরকে যাইতে চাই। বলে ছুটতে লাগলো দরজার দিকে। কিন্তু দরজা খুলছে না।

আপনি নরকে যাবেন মানে? আপনাকে কে বলেছে যে আপনি স্বর্গে আছেন? এটাই নরক জনাব আবু কাউছার, আপনি নরকেই আছেন! বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো পিপ।

জীবনভর দৌড়ের উপর থাকা কাউয়া স্বভাবের খ্যাপাটে আবু কাউছার অনন্তকালের জন্য আটকা পড়ে রইলো তার ব্যক্তিগত ইচ্ছাপূরণের স্বর্গে।

[ছায়াঃ অ্যা নাইস প্লেস টু ভিজিট, চার্লস বাউমন্ট]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *