প্রথম কণ্ঠ
“কিন্তু বলো আমায়, বলো! কথা বলো,
আবারো আওয়াজ তোলো তোমার ঐ নরম কণ্ঠে—
কিসের জোরে ছুটে চলেছে এই জাহাজ?
কী করছে এই সাগর?”
দ্বিতীয় কণ্ঠ
“এখনো সে কেবল ঈশ্বরের এক গোলাম মাত্র,
সাগরটার নিজস্ব কোনো প্রবাহ নেই;
তাঁর উজ্জ্বল বড় চক্ষু, নীরবে
তাকিয়ে আছে মাথার উপরের চাঁদটার দিকে—
সে হয়তো জানতোই না কোন দিকে তাঁর গন্তব্য,
চাঁদটা তাঁকে পথ দেখাচ্ছে কোমলতায় অথবা নিষ্ঠুরতায়।
দেখো, ভাই, দেখো, কতটা উদারচিত্তে
সে চোখ ফেলেছে নিচে, তাঁর উপর।”
প্রথম কণ্ঠ
“কিন্তু জাহাজটা কিভাবে ছুটছে এমন গতিতে,
কোনো বাতাস ছাড়াই, কোনো ঢেউ ছাড়াই?”
দ্বিতীয় কণ্ঠ
“বাতাসটাকে কেটে আগেই ভাগ করা হয়েছে,
আর বেষ্টন করা হয়েছে পেছন থেকে।
ওড়ো, ভাই, উড়াল দাও! উপরে, আরও উপরে!
নয়তো আমরা হয়ে পড়বো বিলম্বিতঃ
নাবিকের মোহটা কেটে গেলেই
শ্লথ হয়ে পড়বে জাহাজের গতি।”
আমি জেগে উঠলাম, দেখলাম তখনো আমরা এগুচ্ছি সামনের দিকে
যেন একটা শান্ত-সুন্দর আবহাওয়ায়ঃ
তখন ছিলো রাত, প্রশান্তির রাত, চাঁদটা দাঁড়িয়ে ছিলো উপরে;
মরা মানুষ গুলো সব দাঁড়িয়ে ছিলো একসাথে।
একসাথে সব দাঁড়িয়ে রইলো ডেকের উপর,
মৃতদের অন্ধকূপের এক মিস্তিরির জন্যেঃ
আমার উপর দৃষ্টি ফেললো সবগুলো পাথুরে চক্ষু,
যে চোখে ঝিকঝিক করছিলো চাঁদের আলো।
মরণকালের সেই তীব্র যন্ত্রণা আর অভিশাপ,
এক মুহূর্তের জন্যেও মুছে যায়নি তাঁদের চাহনি থেকেঃ
আমি চোখ সরাতে পারছিলাম না তাঁদের চক্ষু থেকে,
না পারছিলাম উপরের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করতে।
আর এখন তুলে নেয়া হলো সম্মোহনটা, আবারো একবার
আমি দেখলাম সবুজ সমুদ্রটা,
আর চোখ রাখলাম আরও দূরে, সামান্যই দেখতে পেলাম
যা কিছু দেখা হয়েছিলো আগে—
একটা নির্জন রাস্তায় একাকী একজনের মত
যে ভীত পায়ে হেঁটে বেড়ায় শঙ্কায়,
মাথাটা শুধু একবার ঘুরিয়েই সে হাঁটতে থাকে,
দ্বিতীয়বার আর সাহস করে না মাথা ঘুরাবার;
কারণ সে জানে, খুব নিকটে, পেছনেই
হেঁটে আসছে এক ভয়ঙ্কর বর্বর।
কিন্তু শিঘ্রী একটা বাতাস এসে নিঃশ্বাস ফেললো আমার ঘাড়ে,
সৃষ্টি হলো না কোনো শব্দ কিংবা স্পন্দনঃ
তাঁর পথ সমুদ্রে ছিলো না,
ছিলো তরঙ্গে কিংবা ছায়ায়।
বাতাসটা উস্কে দিলো আমার চুল, ছুঁয়ে গেলো আমার গণ্ডদেশ,
বসন্তের ঘাসের একটা ধমকা হাওয়ার মতন—
এটা অদ্ভুতভাবে মিশে গেলো আমার ভয়ে,
তবুও তাঁকে মনে হলো বরণীয়।
দ্রুত, ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে চললো জাহাজটা,
তবুও যেন সে আলতো ভাবেই ভেসে বেড়াচ্ছিলো জলের উপর,
বইছিলো সুরেলা, মিষ্টি মৃদু মন্দ বাতাস,
সে বয়ে চললো শুধুই আমার উপর।
ওহ! সত্যিই এটা আনন্দের স্বপ্ন!
উপরে কি আমি বাতিঘরটা দেখছি?
এটা কি পাহাড়টা? এটা কি গির্জাটা?
এই কি আমার নিজের দেশ?
আমরা ভাসতে ভাসতে চলে গেলাম পোতাশ্রয়ে,
আর আমি প্রার্থনা করলাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে—
আমাকে জাগিয়ে তোলো, হে ঈশ্বর!
কিংবা আমায় ঘুম পাড়িয়ে দাও চিরতরে।
পোতাশ্রয়ের পানিটা ছিলো কাঁচের মতই স্বচ্ছ,
সেটা বিছিয়ে ছিলো মসৃণতায়!
আর জলের উপর শুয়ে ছিলো জ্যোৎস্নাটা,
এবং চাঁদের ছায়াটা।
পাথরগুলো জ্বলজ্বল জ্বলছিলো, গির্জাটাও,
এটা দাঁড়িয়ে আছে পাথরগুলোর উপরেঃ
চাঁদের আলোটা ডুব দিলো নীরবতায়,
দৃঢ় দাঁড়িয়ে রইলো বায়ুনিশানটা।
নীরব আলোয় শুভ্র হয়ে উঠেছিলো সাগরটা,
একই জায়গা থেকে জেগে উঠছিলো,
অনেক গুলো পূর্ণ অবয়ব, আর ছায়াগুলোও
ভেসে উঠছিলো অগ্নিবর্ণে।
গলুই থেকে সামান্য একটু দূরেই
ছিলো সেই অগ্নিবর্ণের ছায়া গুলোঃ
আমি ঘুরে চোখ রাখলাম ডেকের উপর—
ওহ ঈশ্বর! সেখানে আমি কি দেখলাম!
প্রতিটা লাশ শুয়ে আছে চিত হয়ে, প্রাণহীন, নিথর,
আর পবিত্র ক্রুশের সাথে!
একটা নূরের অবয়ব, একটা দেবদূত!
দাঁড়িয়ে ছিলো প্রতিটা লাশের উপর।
এই যে দেবদূতের দল, প্রত্যেকেই নাড়ালো তাঁর হাতঃ
এটা ছিলো একটা স্বর্গীয় দৃশ্য!
সবাই যেন একেকটা সংকেত, ভূমির দিকে,
যেন একেকটা জীবন্ত আলো;
এই যে দেবদূতের দল, প্রত্যেকেই নাড়ালো তাঁর হাতঃ
তাঁদের কণ্ঠ থেকে কোনো আওয়াজ বেরুলো না,
আওয়াজহীন; কিন্তু ওহ! নীরবতাটা
সঙ্গীতের মতই ডুব দিলো আমার হৃদপিণ্ডে।
কিন্তু অচিরেই শুনতে পেলাম বৈঠার আওয়াজ,
শুনলাম পাইলটের হর্ষধ্বনি;
কেউ যেন জোরপূর্বক ঘুরিয়ে দিলো আমার মাথাটা,
এবং আমি দেখলাম একটা নৌকা।
পাইলট আর পাইলটের ছেলেরা,
শুনলাম তাঁরা দ্রুত এগিয়ে আসছেঃ
হে স্বর্গের প্রভু! কি আনন্দ
মৃতগুলো ছুঁড়তে পারছিলো না কোনো অভিশাপ।
আমি তৃতীয় আরেকজনকে দেখলাম — শুনতে পেলাম তাঁর গলার আওয়াজঃ
এটা তো সেই দরবেশ!
সে উচ্চস্বরে গেয়ে উঠলো তাঁর ঐশ্বরিক সুর
যে সুর বেঁধেছিলো সে জঙ্গলে।
আমার আত্মাকে সে পাপমুক্ত করবে, মুছে দিবে
অ্যালবাট্রসের রক্ত।
ষষ্ঠাংশের সমাপ্তি (চলবে…)
মূলঃ দ্যা রাইম অব দ্যা এইনশানট মেরিনার — স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ