একটা ক্লান্ত সময় পার হচ্ছিলো। প্রতিটা কণ্ঠনালী
শুকিয়ে হয়েছিলো কাঠ, চকচক করছিলো প্রতিটা চক্ষু,
একটা ক্লান্ত সময়! একটা ক্লান্ত সময়!
কিভাবে চকচক করছিলো প্রতিটা ক্লান্ত চোখ,
যখন চোখ রাখলাম পশ্চিমাভিমুখে, দেখলাম
কিছু একটা নড়ছে আসমানে।
প্রথমে মনে হলো যেন একটা ছোট্ট কণা,
পরে মনে হলো এক খণ্ড কুয়াশা;
এটা ঘুরতে থাকলো, ঘুরতেই থাকলো, অবশেষে ধারণ
করলো একটা নির্দিষ্ট আকৃতি, আমি জানি।
একটা কণা, এক খণ্ড কুয়াশা, একটা আকৃতি, আমি জানি!
তখনো এটা ধেয়ে আসছিলো নিকটে, আরও নিকটেঃ
যেন একটা জলপরীকে ফাঁকি দিয়ে
ডুবলো, ভাসলো আবার গোত্তা মারলো।
তৃষ্ণায় ফেটে চৌচির কণ্ঠনালী, সিদ্ধ হওয়া কৃষ্ণ কালো ঠোঁট নিয়ে
আমরা না পারছিলাম হাসতে, না পারছিলাম বিলাপ করতে,
প্রচণ্ড খরায় মূক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সবাই!
আমি দাঁত বসিয়ে দিলাম নিজের হাতে, চুষে নিলাম রক্ত,
আর চিৎকার করলাম, একটা পাল! একটা পাল!
তৃষ্ণায় ফেটে চৌচির কণ্ঠনালী, সিদ্ধ হওয়া কৃষ্ণ কালো ঠোঁট নিয়ে
মুখ হাঁ করে তাঁরা আমার ডাক শুনলোঃ
আহ ঈশ্বর! একটা কষ্ট মাখা হাঁসি ফুটে উঠলো তাঁদের ঠোঁটে, আনন্দে,
সবটা এক নিঃশ্বাসে শুষে নিলো,
যেন তাঁরা সবাই ঢক ঢক করে জল গিলছিলো।
দেখো! দেখো! (আমি চিৎকার করলাম) সে তো আর দাঁড়াচ্ছে না!
এখানে আমাদের এগিয়ে নিচ্ছে,
কোন বাতাস ছাড়াই, কোন ঢেউ ছাড়াই,
সে অবিচল এগুচ্ছে তাঁর লম্ব হাঁটুতে।
পশ্চিমা বাতাসটা নিয়েছিলো আগুনের রূপ,
দিনটা ভালোয় ভালোয় শেষ হচ্ছিলো!
পশ্চিমা বাতাসটায় গা এলিয়ে
আরাম করছিলো বৃহদাকার জলমলে সূর্যটা,
তখন সেই অদ্ভুত আকৃতিটা হঠাৎ চলে গেলো
আমাদের আর সূর্যটার মাঝখান দিয়ে।
আর সূর্যটা ভরে গেলো ছোপ ছোপ দাগে,
(স্বর্গ মাতা আমাদের কৃপা করেছেন)
যেন সে একটা অন্ধকূপের ভিতর দিয়ে
উদিত হলো তাঁর বৃহৎ, পোড়া মুখটা নিয়ে।
হায়! (ভাবলাম আমি আর আমার হৃদপিণ্ডটা উচ্চস্বরে কেঁপে উঠলো)
কত দ্রুত সে কাছে আসছে আর আসছে!
ঐ পালগুলো কি তাঁর যা সূর্যের আলোয় জলমল করছে
ঠিক উতলা মাকড়সার জালের মত?
ঐ পাঁজর গুলো কি তাঁর, যার মধ্য দিয়ে
সূর্যটা উঁকি মারে, যেমনটা মারে ঝাঁঝরির মধ্য দিয়ে?
আর ঐ যে মহিলা, সব কি তাঁর নাবিকদল?
এটা কি একটা মৃত্যু? দ্বিতীয় আর কোন মৃত্যু কি আছে?
ঐ মহিলা কি মৃত্যুর স্ত্রী?
তাঁর রক্তিম ঠোঁট, উদাস চাহনি,
তাঁর তালা গুলো ছিলো সোনার মতই হলদেঃ
তাঁর শরীরের চামড়াটা ছিলো কুষ্ঠরোগীর মতই সাদা,
সেই ছিলো দুঃস্বপ্ন, সেই ছিলো মৃত্যু সম জীবন,
যে ঠাণ্ডায় ঘন করে দেয় পুরুষের রক্ত।
নিকটে আসলো উলঙ্গ বেসামাল জাহাজটা,
আর তাঁরা দুইয়ে মিলে শুরু করলো পাশা খেলা,
“খেলা শেষ! জিতে গেছি! জিতে গেছি!”
বললো সে, আর শিস বাজালো তিন বার।
ডুবে গেলো সূর্যের বৃত্তাকার প্রান্তটা, তারা গুলো ছুটাছুটি করছিলো,
অন্ধকার আসলো তাঁর বড় এক পা ফেলে,
দূরে কোথাও, সমুদ্রের ওপাড় থেকে কানে আসছিলো ফিসফিসানি,
ছুটে আসছিলো ভূতুড়ে-চিৎকার।
আমরা শুনলাম, মাথা উঁচিয়ে পাশ দিয়ে তাকালাম,
আমার হৃদপিণ্ডটা একটা কাপের মতই ভরে গেলো ভয়ে,
মনে হলো যেন ভয়টা চুমুক বসাবে আমার রক্তে!
তারা গুলো মিটিমিটি জ্বলছিলো ক্ষীণ আলোয়, রাতটা তখন বেশ ঘন,
ল্যাম্পের আলোতে জাহাজ চালকের মুখটা দেখাচ্ছিলো সাদা;
পাল গুলো থেকে ঝরে পড়ছিলো শিশির কণা—
ততক্ষণে শিং ওয়ালা চাঁদটা বেয়ে বেয়ে উঠছিলো
পূর্ব সীমান্তের উপরে, সাথে ছিলো একটা জলমলে তারা।
একজনের পর একজন, তারায় ঘেরা চাঁদের আলোতে,
গোঙ্গানোর কিংবা নিঃশ্বাস নেওয়ারও সময় ছিলোনা,
প্রত্যেকেই তাঁর বিবর্ণ যন্ত্রণায় কাতর চেহারাটা
আমার দিকে ঘুরালো, আর অভিসাপ বিচ্ছুরিত হচ্ছিলো তাঁর চোখ থেকে।
দুই শ’টা জীবিত লোক,
(আমি আর কোন গোঙ্গানি কিংবা নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাইনি)
তাঁরা যেন একেকটা জড় মাংস পিণ্ড,
ঝরে পড়লো এক এক করে।
তাঁদের শরীর থেকে উড়ে গিয়েছিলো আত্মাটা,—
আত্মারা উড়ে যাচ্ছে আশীর্বাদ করতে নয়তো অভিশাপ দিতে,
আর প্রতিটা আত্মা, শোঁ শোঁ করে আমাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলো,
যেন আমার ধনুকের একেকটা তীর!
তৃতীয়াংশের সমাপ্তি। (চলবে)……
মূলঃ দ্যা রাইম অব দ্যা এইনশানট মেরিনার — স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ